মোহসেন আরীশীর মুখোমুখি
ইসফানদিয়র আরিওন : আমার পক্ষ থেকে ও বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি মিসরের সাংবাদিক ও লেখক মোহসেন আল-আরিশিকে। জনাব মোহসেন, আপনি বাংলাদেশকে নিয়ে হাসিনা : হাকাইক ওয়া আসাতির নামে একটি বই লিখেছেন। আমি তা পড়েছি এবং পড়ে বেশ মুগ্ধ হয়েছি। এর পর আমি তা অনুবাদ করে ফেলি। চমৎকারভাবে আপনি আরব জাতির কাছে বাঙালিদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সে জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। এমন একটি কাজের জন্য আপনি আমার দেশবাসীর অকৃত্রিম বন্ধুও বটে। আপনার নিকট আমার মূল প্রশ্ন হল: আমাদের দেশের ইতিহাসের প্রতি আপনি কীভাবে কৌতুহলী হয়ে উঠলেন?
মোহসেন আল-আরিশি : প্রায় ছয় বছর পূর্বে মিসরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন জনাব মিজানুর রহমান। আর তখন মিসরীয় জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। সেগুলোতে সর্বদা দারিদ্র্য, বন্যা ও কত জন মানুষ বন্যাপীড়িত হল তা নিয়েই লেখালেখি হত। তখন সাংবাদিকদের মতবিনিময় এক সভায় জনাব মিজানুর রহমান অনেক দুঃখপ্রকাশ করে বললেন: “এগুলো আমার দেশের প্রকৃত চিত্র নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ চিত্র এমন পাল্টে গিয়েছে যার সাথে আপনারা যা লিখছেন তার কোনো মিল নেই।” উক্ত সভায় অনেক মিসরীয় সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর কথায় আমি অনেক প্রভাবিত হলাম। আমার ভালোও লাগল তাঁর কথা। বিশেষ করে, আরব বিশ্বে ও মিসরে তাঁর দেশ নিয়ে ধারণা পাল্টাতে তিনি হলেন অনুপ্রেরণা দানকারী। কারণ, মিসর বেশ বড়ো একটি দেশ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে আমি তাঁর কাছে সময় চাই। তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাক্ষাৎকারে রাজি হলেন এবং তাতে তাঁর দেশ সম্পর্কে সব কিছু আমাকে বললেন—তাঁর দেশ কেমন ছিল, তিনি যখন জন্মেছিলেন তখন কেমন ছিল, শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন কেমন ছিল। অতঃপর রাষ্ট্রদূত উঠে পড়লেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের একবার দাওয়াত করা হয়। আমি তাঁদের মধ্যে একজন ছিলাম।
ই.আ.: কোন সালের কথা এটা? কখন এমনটা ঘটেছিল?
মো.আ.: সালটা আমার এখন সঠিক মনে নেই। কিন্তু আমার মনে হয় এটা ছয় বছর আগের ঘটনা বা এমনই কিছু একটা হবে। কারণ আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। অতএব, আমার এখন মনে নেই। আমাদের অধিকাংশ সাংবাদিকরা বেশ অভিভূত হয়েছিলাম যখন আমরা রাস্তায় বাঙালিদের দেখছিলাম এবং তাদের চেহারা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। এর পর আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই…
ই.আ.: ঠিক কত সালে, মনে নেই আপনার?
মো.আ.: এটা আমার প্রথম সফর ছিল। শীঘ্রই দিনক্ষণ আমার মনে পড়বে। তো সেখানে আমি দেখেছিলাম, কোথায় তাঁকে হত্যা করা হয়, কীভাবে পুরো পরিবারটিকে হত্যা করা হয়। সব কিছু ছিল বেশ দুঃখজনক। যেহেতু আমি লেখক ও মানুষও বটে সেহেতু হৃদয়ের অনুভূতি ও মানুষ হওয়ার অনুভূতি থেকে লেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। কল্পনা করতে থাকি কেমন করে বঙ্গবন্ধু বসে ছিলেন, কীভাবে অপরাধীরা প্রবেশ করে ও পরিবারটির ওপর গুলি বর্ষণ করে, শিশু ও দৌহিত্রদের ওপর গুলি বর্ষন করে।
ই.আ.: সব কিছু আপনি কল্পনা করেছিলেন?
মো.আ.: ঠিক তাই। অতঃপর আমরা জাতীয় জাদুঘরে যাই।
ই.আ.: জাতীয় জাদুঘরে?
মো.আ.: ঠিক তাই।
ই.আ.: শাহবাগে যেটা?
মো.আ.: জি। আমরা স্মৃতিসৌধও দেখতে গেলাম। দেখলাম, শহিদদের আত্মা এই স্মৃতিসৌধের দিকে ধেয়ে আসছে—ধেয়ে এসে দরদালানের ভেতর দিয়ে হুমড়ি খেয়ে ঊর্ধ্বাকাশকে বিদারিত করছে। এমন নকশা দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম।
ই.আ.: এটা কি জাতীয় জাদুঘরে ছিল?
মো.আ.: এটা ছিল স্মৃতিসৌধ যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদদের অমর করে রাখা হয়েছে। যখন আমি মিসর ফিরে গেলাম তখন আমি জনাব মিজানুর রহমানের সাথে দেখা করলাম। তাঁকে বললাম, আমি বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে চাই। তিনি আমার কথা বিশ্বাসই করলেন না। বললেন, সত্যিই? কারণ এখানে কোনো আরবি পত্রিকায় বাংলাদেশ নিয়ে একটি বাক্য নেই অথবা আরবি ভাষায় লিখিত একটি বই নেই যা আমার দেশের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে রচিত হয়েছে। যেন মনে হয় আমার দেশটি পৃথিবীর মানচিত্রেই নেই। বাংলাদেশকে কেবল তখনই স্মরণ করা হয় যখন সেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা দুর্যোগ দেখা দেয়। বাংলাদেশ কী? সেখানকার জীবনধারা কেমন? সেখানকার সভ্যতা কী? সেখানকার মানুষজন কীরূপ? সেখানকার কত সংখ্যক মানুষ যুদ্ধে নিহত হয়েছে? কত সংখ্যক নারী ধর্ষিত হয়েছে? কেউই তার খোঁজ রাখে না। আমার মনে হয়, অন্যদিকে এটাই বিভিন্ন আরব দেশে গণমাধ্যমের সাথে প্রভাব অথবা সম্পর্কের শক্তিতে ফিরে আসে। বরং বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে গণমাধ্যমের ও যোগাযোগের সক্রিয়তা ছিল না। এই সত্যই জনাব মিজানুর রহমান আমাকে দুঃখের সাথে বলেছিলেন। মনে হয় তিনি এখন কানাডায় আছেন।
ই.আ.: তাই না কি?
মো.আ.: আমার তাই মনে হয়।
ই.আ.: রাষ্ট্রদূত হিসেবে?
মো.আ.: জি। অথবা তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। আমিও এর মধ্যে কানাডা গিয়েছিলাম। ঠিক জানি না, এখনও কি তিনি সেখানে কর্তব্যরত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা তা হল, তিনি আমাকে সাহস যুগিয়েছিলেন। আমাকে বাংলাদেশে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
ই.আ.: মানে, জনাব মিজানুর রহমান আপনাকে গবেষণায় সাহায্য করেছিলেন?
মো.আ.: তিনি আমাকে আরেকবার বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, আপনি এবার সেখানে আপনার গবেষণা চালিয়ে যেতে পারবেন ও চিন্তাও করতে পারবেন। অতঃপর আমি যখন ফিরে এলাম তখন তিনি আমার জন্য এমন কিছু বই নিয়ে এলেন যেগুলোতে শেখ হাসিনা তথা শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারে কী ঘটেছিল তা নিয়ে আলোচনা আছে। এমন কিছুর চিন্তাও ভয়ানক। আল্লাহ্ কে ধন্যবাদ যে, আমি বইগুলো মন দিয়ে পড়লাম এবং প্রায় তিন বছর বা আড়াই বছর ধরে সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে ধ্যানমগ্ন হলাম। আর নয় মাসে বইটি লেখা শেষ করলাম।
ই.আ.: এটা তো কাকতালীয় ব্যাপার।
মো.আ.: অদ্ভুত ও কাকতালীয় একটা ব্যাপার যেন গর্ভবতী কোনো মহিলা যে নয় মাসের গর্ভধারণকাল অতিক্রম করেছে এমন কিছুর জন্ম দিয়েছে। সাংবাদিক ও লেখকদের মনন সবসময় গর্ভবতী মহিলার মতোই হয়ে থাকে। তাদের মন নানাবিধ চিন্তায় পরিপূর্ণ থাকে যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। একসময় আসে যখন তা পরিপূর্ণ হয়ে যায় তখন তারা এ চিন্তাকে বের করে দেয়। প্রসবের মুহূর্ত কিংবা জন্মের মুহূর্তের মতো ব্যাপারটা। এতে অবশ্যই লেখকের ব্যথা-বেদনা থাকে যা তৎসংশ্লিষ্ট চিন্তাগুলোকে লালন করার সময় থেকে শুরু হয়, যা আবার তার কল্পনায় জন্ম নেয় ও ব্যথা-বেদনা সেখানেই পূর্ণতা পায়। একইভাবে যা সে লিখছে তাও তাকে কষ্ট দেয়। কারণ সে ভাবে, আমি এটা বোঝাতে চেয়েছি, আমি ওটা বোঝাতে চেয়েছি, আমি এই ধরনের মন-মেজাজ অধ্যয়ন করি ও তার সাথে ব্যক্তিত্বকে বিশ্লেষণ করি। অর্থাৎ, শেখ হাসিনাকে নিয়ে লিখিত আমার বইয়ে আমি তাঁর ব্যক্তিত্বের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছি—কীভাবে তাঁর নামডাক চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল ও তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন, যখন তাঁর পিতাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর কন্যা তাঁর সাথে কীভাবে বসতেন ও তাঁকে কীভাবে অনুকরণ করতেন। অতঃপর যখন তিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেন।
ই.আ.: মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা তিনি কি ঢাকায় করেছিলেন?
মো.আ.: আমার তাই মনে হয়। আমার মনে নেই। তবুও আমার তাই মনে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আমি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিয়েছি। আল-হামদু লিল্লাহ্, প্রথম আরব সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে আমাকে বিবেচনা করা হয় যে আরবি ভাষায় বাংলাদেশ নিয়ে বই লিখেছি।
ই.আ.: তা তো ঠিকই।
মো. আ.: আমার মনে হয় না যে, ইংরেজি ভাষাতেও এই বিষয়ে বই আছে।
ই.আ.: আমার একটা প্রশ্ন আছে আপনার কাছে। সত্যিই কি আরব দেশগুলোতে এই বিষয় নিয়ে কোনো বই বা গবেষণাপত্র নেই?
মো.আ.: আমার মনে হয় না। অবশ্যই বাংলাদেশের লেখকরা ও সাংবাদিকরা নিজেদের দেশ নিয়ে বাংলা ও ইংরেজিতে বই লিখেছেন। আমি বেশ নিশ্চিত যে, কোনো মিসরীয় বা আরবি লেখক বাংলাদেশ নিয়ে আমার দেশে একটিও শব্দ লিখেছে।
ই.আ.: একটি শব্দও না?
মো.আ.: একটি শব্দও না।
ই.আ.: আপনি কি ইংরেজিতে লিখিত এমন কোনো বই ব্যবহার করেছেন?
মো.আ.: এ ব্যাপারে আমি অধিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্মরণ করতে চাই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আরবি খবরের কাগজে বাংলাদেশ নিয়ে যা লিখিত হত তা বাঙালি জাতির জন্য অপমানকর ও দুঃখজনক।
ই.আ.: কোন সালের কথা বলছেন আপনি?
মো.আ.: ১৯৭১ সাল। যুদ্ধের বছরের কথা বলছি। সে সময় খবরের কাগজে লিখিত হত যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহীদের নেতা। তিনি বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছেন।
ই.আ.: শুধু বিদ্রোহী?
মো.আ.: শুধু তাই। যখন থেকে আমি গবেষণা করছি তখন থেকে আমি বাংলাদেশ নিয়ে একটিও ইতিবাচক শব্দ পাই নি।
ই.আ.: কেবল নেতিবাচক?
মো.আ.: শুধু নেতিবাচক ও অপরাধমূলক। আরব গণমাধ্যম এমনটা করেছে। বাঙালিদের সাথে তারা অপরাধ করেছে। তারা তাদের গণমাধ্যমে প্রচার করেছে যে, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে এমন বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের দ্বারা তারা অবরুদ্ধ, নিপীড়িত। সত্য বলতে কি, ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেই এতে দুঃখ পেয়েছি ও তাজ্জব হয়েছি। এ ব্যাপারটাও আমাকে বইটা শেষ করতে সাহস যুগিয়েছে। আর আমি ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বইটি লিখি নি। লিখেছি মানবিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আরব বিশ্বের সামনে আমি বাঙালি জাতির এই ঘটনা উপস্থাপন করেছি যেখানে মুসলিম জাতি মুসলিম জাতিরই হাতে কোরবানির পশুর মতো জবাই হয়েছিল। বন্ধুবান্ধব ও সাংবাদিক-লেখকদের সাথে এ ব্যাপারে আমি অনেক আলোচনা করেছি। কেন শেখ মুজিবুর রহমানকে, তাঁর দলীয় সহযোগীদেরকে ও বাঙালি জাতিকে সন্দেহের চোখে দেখা হত যে, তারা সবাই বিদ্রোহী ও সবাই মিলে তাদের প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে? এসব কিছুই আমার বইয়ে এসেছে। সত্যি কথা বলতে কি, বাঙালি জাতিকে এভাবে দেখা হত যে, তারা দাসশ্রেণির অন্তর্গত যাদের জন্য হয়েছে শাসক তাদের হুকুম করবে ও তারা তা পালন করবে।
ই.আ.: মানে পশ্চিম পাকিস্তান মনে করত এ জাতি তাদের গোলাম?
মো.আ.: পাকিস্তান তাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। পাকিস্তানের শাসক তাদের যা হুকুম করত তারা তা তামিল করতে বাধ্য থাকত। তোমাদের কোনো অধিকার নেই। আমরা তোমাদের হুকুম করব ও তোমরা বিনিময়ে মজুরি পাবে। বরং সর্বদা তোমাদের মাথা প্রভুর সামনে ঝুঁকে থাকবে। বাঙালি জাতিকে রক্ষা করতে ও নিজেদের সভ্যতা, ইতিহাস ও মর্যাদা তাদের মনে করিয়ে দিতে তিনি সফল হন। তিনি বলেন, “এ জাতি দাসজাতি নয়। এই পৃথিবীতে তাদের যেমন অধিকার আছে আমাদেরও তেমনি অধিকার আছে। নিজেকে রক্ষা করতে আমাদের সংগ্রাম করে যেতেই হবে।” আমার বইতে আমি এমন কিছুর কথা বলেছি যা পূর্বে কেউই বলেন নি। এমনকি বাংলাদেশি লেখকরা পর্যন্ত না। স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ কি আপনি জানেন? শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার কারণ কি আপনি জানেন? পাকিস্তান যখন বাংলা ভাষাকে মুছে ফেরার চক্রান্ত করল তখন তিনি সেটার প্রতিরোধ করলেন। আর তখনই তাঁকে আক্রমণ করা হল। আত্মপরিচয়কে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পাকিস্তান যখন তা ছুঁড়ে ফেলল শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অবস্থানে অনড় রইলেন ও তা প্রত্যাখ্যান করলেন। এভাবে কেউই তো মনে করে না।
ই.আ.: শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটা আপনি পড়েছেন?
মো.আ.: জি, আমি পড়েছি। এর সাথে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমি স্মরণ করতে চাই। বাঙালি জাতির সেসব জানাও উচিত। তারা অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। নেতৃত্বের স্থানীয়। আমার বইয়ে আমি সেসব আলোচনা করেছি। যখন আয়াতুল্লাহ্ খোমেইনি ইরান আসলেন তিনি ইসলামি বিপ্লবের ডাক দিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্য ক্যাসেটের ফিতায় রেকর্ড করে ইরানে তা ছড়িয়ে দিলে এই বিপ্লব শুরু হয়। কারণ তখন তিনি পারিতে নির্বাসনে ছিলেন। কিন্তু আয়াতুল্লাহ্ খোমেইনিই প্রথম নেতা নন যিনি বিপ্লবের জন্য ক্যাসেটের ফিতা ব্যবহার করেছিলেন। বরং তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আপনি কি তা স্মরণ করেন? যখন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন তাঁর কণ্ঠ ক্যাসেটে রেকর্ড করা হয়েছিল এবং তা দেশব্যাপী ছড়িয়েও পড়েছিল। তখন বাঙালি জাতির বিপ্লবী কণ্ঠস্বর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কেউই পূর্বে এ কথা বলেন নি। আল্লাহ্ কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। তাঁর ফজলে আমি বাঙালি জাতি নিয়ে অধ্যয়ন যখন করেছি তখন বেশ একাত্ম ছিলাম। আরব বিশ্বের সামনে ও আরব জাতির সামনে বাঙালি জাতির সম্মান ও অধিকার সমুন্নত রাখতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এজন্য আল্লাহ্ কে ধন্যবাদ।
ই.আ.: আপনি কি শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচা পড়েছেন?
মো.আ.: না, না। আমি আপনারে বলেছি যে, আমি শেখ মুজিবুর রহমানের বা শেখ হাসিনার জীবনী লিখতে তাই নি। আমি ওনার বই এই কারণে পড়তে চাই নি কারণ তাতে আমি আমার আবেগকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারি। আমি সেসব পড়া হতে নিজেকে বিরত রেখেছি। কিন্তু আমি সত্যকে জানতে চেয়েছি, অতঃপর মানবিকতায় সেগুলো রূপান্তর করতে চেয়েছি যাতে আমি সৃজনী সত্তাকে সজ্জিত করতে পারি। আমি পরে শেখ মুজিবুর রহমানের রোজনামচা পড়েছি। প্রকৃতপক্ষে, সব কিছু আমি পড়ে দেখেছি। শেখ হাসিনা তাঁর পিতাকে নিয়ে যা লিখেছেন তা-ও আমি পড়েছি। পিতা তখন বিদ্যালয়ে পড়তেন। দাদা তাঁর পিতাকে পড়ার বই কিনতে যে টাকা দিতেন তা দিয়ে তিনি অভাবী লোকেদের জন্য জামাকাপড় কিনে তাদের মধ্যে বিতরণ করতেন।
ই.আ.: শেখ হাসিনার লিখিত যে বইটি পড়েছেন সেটির নাম কী?
মো.আ.: সেটা বোধ হয় কোনো বই ছিল না। কিছু মানুষের স্মৃতি, কিছু বইয়ের কিছু কথা। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা তাঁর পিতাকে নিয়ে বিশেষ কোনো বই লেখেন নি। আমি তেমনটাই মনে করি।
ই.আ.: না, শেখ হাসিনা তাঁর পিতাকে নিয়ে বই লিখেছেন।
মো.আ.: বই লিখেছেন।
ই.আ.: বই লিখেছেন।
মো.আ.: আমি জানি না তাহলে। মনে হয় যখন থেকে আমি আমার বইটি লেখা শুরু করেছি তখন পর্যন্ত তিনি এমন কিছু লেখেন নি। শীঘ্রই সে বইটি আমার হাতে আসবে। তাঁর পরিবারকে নিয়ে যা লিখিত হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে যা লিখিত হয়েছে তা বুনিত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশেই তা হয়েছে। আমি তো আরব লেখক। আমি যেখানে থাকি সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে তেমন কিছু তো লেখা হয় না। কোনো প্রশংসাবাণী তো নয়ই। আর আপনি যেহেতু বাংলাদেশ লেখক ও বাংলাদেশ সম্বন্ধে লিখে থাকেন অবশ্যই আমার থেকে ভালো জানবেন।
ই.আ.: শেখ হাসিনা ও শেখ জামালের যে গল্প অর্থাৎ আব্বা আব্বা—এ গল্পটি কোথায় পড়েছেন আপনি?
মো.আ.: আমি পড়েছি…আবেগের চূড়ায় মানুষ তো সত্যই বলে। যখন এই ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে আমি আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কারণ শিশুর পিতা কারাগারে আছে আর ছোটো শিশুটি তার পিতাকে চেনে না। আর সে দেখছে তার বোনের সাথে সে কারাগারের নিকটবর্তী হচ্ছে আর কার বোন আব্বা আব্বা বলে ডাকছেন। শিশুটি জানে না যে, এটাও তার পিতা। কীভাবে এটা সম্ভব। আমিও কি তাঁকে ওভাবে ডাকতে পারি? শেখ হাসিনার পরিবারের যেমন গল্প তেমনটা তো গ্রিক পুরাণ বা ট্রাজিডিতেও নেই। যদি সেসব জায়গায় শেখ হাসিনা ব্যতীত অন্য কোনো মহিলা থাকতেন তবে শা ঘটেছে তা ঘটত। আমার মনে হয় না।
ই.আ.: আপনি বলেছেন যে আপনি যখন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছিলেন তখন মিজানুর রহমান আপনাকে আপনাকে সাহায্য করেছিলেন। অন্য কেউ কি আছেন?
মো.আ.: কায়রোর বাংলাদেশ দূতাবাসে তখন উপদেষ্টা বা কৌঁসুলি ছিলেন শফিকুর রহমান। এই কূটনৈতিককে আমি অনেক গুরুত্ব দেই। তাঁকে ধন্যবাদ। আসলে তিনি ছিলেন আমার ভাইয়ের মতো। পাঠাগারে যখন প্রবেশ করতাম তখন ছিলাম আমরা একই হৃৎস্পন্দনের মতো। যা আমার কাছে কঠিন বলে মনে হত আমি তাঁকে তা জিজ্ঞেস করতাম। নামগুলো তাঁর কাছ থেকে বুঝে নিতাম। তাঁর এমন ধৈর্যের কথা আমি মোটেই ভুলব না। জনাব মিজানুর রহমান ও কৌঁসুলি শফিকুর রহমানকে অনেক ধন্যবাদ। তাঁরা দুজন যখন যে তথ্য চেয়েছি তা দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন। বাংলা ভাষায় তখন আমি আত্মনিয়োগ করেছি। আমি ব্যক্তি বা স্থানের নাম, ঘটনা এসব নিয়ে প্রশ্ন করছিলাম ও ব্যাখ্যা জানতে চাচ্ছিলাম। বিশেষ নাম, স্থানের নাম এগুলো কঠিন ছিল আমার জন্য। কিন্তু সেগুলো খুব চমৎকার ছিল।
ই.আ.: কখন আপনি এই বই লিখতে শুরু করেছিলেন?
মো.আ.: পাঁচ বছর আগের থেকে লেখা শুরু করেছি।
ই.আ.: কোন সাল?
মো.আ.: মনে হয় ২০১২ সাল থেকে। আমার কাগজগুলো ও ভ্রমণ থেকে যা সংগ্রহ করেছি সব জড়ো করেছি। তার পর তথ্যগুলো জড়ো করতে শুরু করি। অর্থাৎ আমি বলব যে, সেগুলো সাজাতে শুরু করি। আরব পাঠক ইতিহাসের ভেতর দিয়ে ভ্রমণের মাধ্যমে, প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করবেন। আর বইটি ছাপানো হয় দুই বছর পূর্বে ২০১৭তে।
ই.আ.: বইতে আপনি লিখেছেন যে, বইটি আপনি নয় মাসে সেষ করেছেন। কীভাবে এটা সম্ভব হল?
মো.আ.: ওভাবে আমি বলি নি যে, নয় মাসে শেষ করেছি। আমি যা বলেছি তা হল, ২০১২ সালে বইটি লেখা আমি শুরু করেছি । লেখকমাত্রই এমন যে, পাঁচ দিন ধরে তিনি লিখছেন আবার লেখা ছেড়ে দিচ্ছেন পরবর্তী নতুন কোনো আবেগ না আসা পর্যন্ত বা নতুন কোনো শব্দবন্ধ না আসা পর্যন্ত। এর মধ্যে তিনি ঘুমুচ্ছেন, হাঁটাহাঁটি করছেন। কিন্তু সবসময় চিন্তা করেই যাচ্ছেন। আবার সম্ভব হলে তিনি ১০ দিন লিখছেন আবার বন্ধ করে দিচ্ছেন। বিষয়ের সব তিনি জড়ো করছেন, সব তথ্য জড়ো করছেন। অতঃপর গিয়ে তিনি সব শেষ করলেন। আমি লিখতে শুরু করেছিলাম এভাবেই। যখন শেষ করেছি তখন নয় মাস হয়ে গিয়েছি। সুতরাং আমি নয় মাসে লিখেছি। নয় মাসেই শেষ করেছি।
ই.আ.: মিসরের The Egyptian Gazette পত্রিকায় আপনি কি এখন সাংবাদিক হিসেবে আছেন?
মো.আ.: আমি এই পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। আর এই পত্রিকাটি ইংরেজি পত্রিকা। এটাই কূটাভাস যে আমি চাই নি ইংরেজিতে বাংলাদেশ নিয়ে লিখি। কারণ ইংরেজি ভাষায় বাংলাদেশ নিয়ে লেখালেখি তো আছেই। কিন্তু আরবিতে তো নেই। বড়ো অভাব। এ জন্য আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে হলে আরবিতেই লিখব। মিজানুর রহমান এই চিন্তায় আমাকে সাহায্য করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রয়োজন নেই যে, আমি তাকে নিয়ে ইংরেজিতে বই লিখি।
ই.আ.: এটা খুবই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত।
মো.আ.: অবশ্যই। আরবি ভাষায় বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রথম বই ও প্রথম শব্দ লেখা হয়েছে। যদিও আমি ইংরেজি পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক তবুও আমি মনে করেছি যে, ইংরেজীতে না লিখে আরবিতে লিখলেই ভালো হবে।
ই.আ.: আমি জানি যে, আপনি কিছু কিছু পত্রিকায় সাপ্তাহিক কলাম লিখেছেন।
মো.আ.: আমি প্রায় পঁচিশ বছর ধরে ইংরেজি ভাষায় মিসরের বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে আসছি। নানা বিষয় নিয়ে আমি লিখেছি। ইংরেজিতেও আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছি। যখনই আমি এ দেশ থেকে ভ্রমণ করে দেশে ফিরে গেছি তখনই আমি যা দেখেছি, যার সাথে মোলাকাত করেছি তা নিয়ে ইংরেজি ভাষায় লিখেছি। কিন্তু বই লেখার সময় আমি ভেবেছি, আরবিতেই লিখব।
ই.আ.: কি পুরনো পত্রিকা?
মো.আ.: আরব দেশসমূহের ও মধ্যপ্রাচ্যের এটা সবচেয়ে প্রাচীন দৈনিক। সবচেয়ে প্রাচীন।
ই.আ.: আমার মনে হয়, আপনি জাতীয় ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন?
মো.আ.: তা তো অবশ্যই। সবসময় আমরা যেসব বিষয় জানি সেসব রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রকৃতপক্ষে আমি পররাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র বিষয়ক রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী। স্বরাষ্ট্র বিষয় আমার ভালো লাগে না। এটাই আমার বিশেষত্ব।
ই.আ.: এখন আমরা আপনার শৈশব সম্পর্কে জানতে মানে আপনি কখন জন্মেছেন ও কোথায় জন্মেছেন?
মো.আ.: ১৯৫৫ সালের ১৭ মার্চ আমি জন্ম নিয়েছি। জন্ম নিয়েছি ইসমাইল গিজায়, ওয়াদ্দুল আরামা নামক জায়গায়। অতঃপর জন্মের দুবছর পর আমরা সিনাই উপদ্বীপের সুহাইল নামক একটা জায়গায় চলে আসি। জায়গাটার নাম আরিশ। সিনাইয়ের রাজধানী। আমার শৈশব কাটে সেখানে।
ই.আ.: এজন্য আরিশি।
মো.আ.: এটা আমার লেখক নাম। মোহসেন আরিশি। তার পর ১৯৬৭ সালে যখন সুহাইল সিনা দখল হয়ে যায় তখন আমরা উদ্বাস্তু হয়ে যাই। আমার বিভিন্ন লেখায় এ নিয়ে আমি অনেক লিখেছি। আমার স্মৃতিতে সেসব কথা খোদিত হয়ে আছে। স্বাধীনতার যুদ্ধে মিলিয়ন মিলিয়ন লোক আহত হয়েছে জেনে আমি আবেগাক্রান্ত হয়ে যাই। কারণ আমিও এ ধরনের পরিস্হিতিত দিনাতিপাত করেছি। আর এই বয়সেও সেই স্মৃতি খোদিত হয়ে আছে। যখন আমি দূরদর্শন দেখি দেখি যে, সুরীয় ইরাকী ও লিবীয় শরণার্থীরা ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর ছেড়ে যাচ্ছে, যুদ্ধ তাদের সব বিধ্বস্ত করে দিয়েছে তখন আমি আমি আমার স্মৃতিতে ফিরে যাই, স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। আমি তখন ছোট্ট শিশু। লুকিয়ে থেকে থেকে আমার মা পরিস্থিতি দেখতেন। আমিও দেখতাম মায়ের সাথে যেমনটা শিশু শেখ জামাল দেখত। মা আমাকে লুকিয়ে রাখতেন কারণ আমি ভয় পেতেন। ভয় পেতাম ইসমাইলীদের। ভয় পেতাম ইয়াহুদীদের। আরিশের ধ্বংসপ্রাপ্ত জায়গাগুলো দেখলে আমি ভয়ে কেঁপে উঠতাম। এর পর যখন আমরা আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম আমরা আমাদের সব বোঁচকা-বুঁচকি নিতে পারলাম না। আমি তখন হালকা-পাতলা। মা আমাকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাঁর হাতে আমার অন্য ভাইরা। সব মানুষের সাথে তাঁরা হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁদের মাঝখানে আমি। যখনই আমি কোনো সুরীয় নারীকে দেখি এভাবে তার কোনো সন্তানসহ দাঁড়িয়ে আছেন তৎক্ষণাৎ ঐ দিনটির কথা আমার মনে পড়ে যায়। আন্তরিকতার সাথে মানবিক ভাবে আমি এই বইটি লিখেছি। যদি কেউ বইটি আরবিতে পড়ে তাহলে তিনি মনে করবেন যে, আমি হয়তো তাঁর শৈশবে এমনকি বড়ো বয়সেও শেখ হাসিনার সাথে ছিলাম। আসলে এই বিপর্যয়গুলোর ভেতর দিয়ে আমিও গিয়েছি।
ই.আ.: আমি পড়েন বুঝতে পেরেছি যে, এমন একটি বই লেখার পেছনে লেখকের ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট প্রভাব রয়েছে।
মো.আ.: ৬৭ সালের যুদ্ধে আমার ও আমার পরিবারের দুর্ভোগ যেন আমি বইটিতে স্মরণ করেছি ও তা-ই বর্ণনা করেছি।
ই.আ.: এর পর প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা আপনি কোথায় করেছেন?
মো.আ.: মাধ্যমিক পর্যায়ে আমি পড়েছি আলি মোবারক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এর পর তো কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে হুকুক নিয়ে পড়েছি।
ই.আ.: সেটা তো মাধ্যমিকে?
মো.আ.: তা-ই। মাধ্যমিকেই। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়তে গিয়ে আমি অনেক উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি।
ই.আ.: কেন?
মো.আ.: আমাদের প্রজন্মের স্বভাব অনুযায়ী আমি পড়াশুনা করি নি। মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই আমরা স্বপ্ন দেখতাম চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশুনা করব।
ই.আ.: স্বপ্ন দেখতেন?
মো. আ.: স্বপ্নই দেখি আমরা। হয় চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ব না হয় প্রকৌশল। ৭০-এর দশকে এটাই স্বপ্নই ছিল। আমি মেধাবী ছাত্র ছিলাম। পঞ্চম শ্রেণি থেকেই আমি প্রথম ছিলাম বিদ্যালয়ে। যখন আমি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে পারলাম না তখন আমার মনে হল, পড়াশুনার বিরতি দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া উত্তম হবে। আমি করলাম কি, কানাডায় চলে গেলাম।
ই.আ.: সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন?
মো.আ.: সেনাবাহিনী বলব না এটাকে। আমাদের মিসরে এটাকে খিদমাহ্ আকবারিইয়াহ্ বলে।
ই.আ.: তো কি করলেন তখন?
মো.আ.: আমি কানাডায় চলে গেলাম। তখন এমনকি এখনও অনেকে আমাকে প্রশ্ন করে যে, কেন কানাডায় যাওয়ার কথা কেন বলছ? আমেরিকার যাওয়ার কথা কেন বলছ না? বা ইউরোপে যাওয়ার কথা কেন বলছ না। আমি জানতামযে, হয়তো কানাডার কথা আমি আমার মন থেকেই বলতাম। আমি বলতাম যে, এই রহস্য আমি একদিন উন্মোচন করবই আর কানাডা যাব ও গিয়ে সেখানে আমার উচ্চতর পড়াশুনা শেষ করব। সেনাবাহিনী থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর মাধ্যমিক শেষ করি এবং আইন ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। তখন আমার খুব আফসোস হল। কারণ, আইন বিভাগের পড়াশুনা বেশ ভালো লাগল। এত কিছু না করলে এতদিনে পড়াটা শেষ করে ফেলতাম। যাই হোক, পাঠ্যবইয়ে আমি খুব প্রভাবিত হলাম।
ই.আ.: হুকুক মানে তো আইন/Law ?
মো.আ.: ঠিক তাই?
ই.আ.: কিন্তু এই আইনশাস্ত্র বলতে মিসরে কোন আইনশাস্ত্র অধীত হয়?
মো.আ.: বেশ সুন্দর একটি প্রশ্ন। আইনশাস্ত্রে আমরা নাগরিক আইন (civil code) অধ্যয়ন করি যা আবার ফরাসি নাগরিক আইন থেকে নেওয়া। এর পর আমি উচ্চতর পড়াশুনায় ইসলামি শরিয়ত পড়ি। কিন্তু কাজের জন্য, ভ্রমণের জন্য ও জীবনের বাস্তবতার উচ্চতর পড়াশুনা সেষ হয় নি। যাই হোক, আলহামদু লিল্লাহ্। ভালোই চলছে সব।
ই.আ.: মানে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনা শেষ করার পরআপন্ কি আবার আইনে উচ্চতর পড়াশুনা শুরু করেছিলেন?
মো.আ.: স্নাতকের এখানে উচ্চতর পড়াশুনা। স্নাতকাত্তর পর্যায়ে আমি ইসলামি শরিয়ত নিয়ে পড়েছি।
ই.আ.: বুঝতে পেরেছি। কেনই-বা আপনি ইসলামি শরিয়ত নিয়ে পড়াশুনা শেষ করেননি?
মো.আ.: কাজের জন্য ও জীবনের অন্যান্য কাজের জন্য ফুরসত মিলে নি। নিজের জন্য যা ভালো, ভালো বেতনের চাকরি, জীবনচক্রে কাদের পর কাজ এসব করতে করতেসময় চলে গেছে। শেষ করতে পারি নি কালই।ছয় মাস পড়ে বাদ দিতে হয়েছিল। এর পর তো আমি ভারত সফর করেছি। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় Media Study বিষয়ে ভর্তি হয়েছি।
ই.আ.: ওখানে কয় মাস কাটিয়েছিলেন?
মো.আ.: ওখানে পড়াশুনা করাটা ছিল আমার জন্য একটা বিশেষ সুযোগ।
ই.আ.: কোন সালের কথা এটা?
মো.আ.: ১৯৯৮ সালের কথা। জওহরলাল নেহরু উচ্চতর সরকারি ইন্সটিটিউট INS (International Institute for Mass Communication) থেকে ডিপ্লোমা করার সুযোগ পেয়েছি আমি। আল্লাহ্ কে ধন্যবাদ যে, অল্প সময়ের মধ্যে আমি ডিপ্লোমা শেষ করেছি আমি। ছয় মাসে আমি এটা শেষ করি।
ই.আ.: এটা তাহলে ডিপ্লোমা ছিল। আচ্ছা, যখন আপনি ভারতে ছিলেন আপনি কি ভারতীয় উপমহাদেশ নিয়ে কোনোরূপ গবেষণা করেছিলেন?
মো.আ.: আমার স্বভাবটাই এরূপ যে, আমি যখন কোনো দেশ ভ্রমণে যাই তা সে দেশ ভারতীয় উপমহাদেশের হোক বা এশিয়া-আফ্রিকার কোনো দেশ হোক আমি সে দেশের প্রকৃতি, মানুষ সম্পর্কে জানতে পছন্দ করি। ভারতে আমি ঠিক কাই করেছি। একই কাজ আমি বাংলাদেশের করেছি। মানুষের সাথে কথা বলতে এমনি পছন্দ করি। এই মানুষটা গরিব, ওই মানুষটা ধনী, এই মানুষটা এরূপ, ওই মানুষটা ঐরূপ এটা জানতে আমার ভালো লাগে। আমি মানবিকতা ভালোবাস। মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হতে আমার ভালোলাগে।
ই.আ.: আচ্ছা আপনি কি ওখানে ভ্রমণ করেছেন?
মো.আ.: ভারতে?
ই.আ.: জি?
মো.আ.: আমি অনেক প্রদেশ ঘুরেছি ভারতে। কোনো হিন্দু মানুষের বাসায় প্রবেশ করতে আমি খুব উত্সাহী ছিলাম। আমি দেখতে চাইতাম, তারা কীভাবে বসবাস করে। কাদের রীতিনীতি আমি খুব জানতে চাইতাম। খুব ইচ্ছে করত তাদের ঘরে প্রবেশ করে দেখতে যে কীভাবে তারা থাকে, কীভাবে কারা খাওয়া-দাওয়া করে। এটা আমার খুব গোপন একটা স্বভাব।
ই.আ.: দিল্লিতে গিয়েছেন আপনি?
মো.আ.: আমরা তো দিল্লিতেই থাকতাম। কিন্তু আগ্রা ঘুরতে গিয়েছি।
ই.আ.: তাজমহল?
মো.আ.: প্রকৃতই। এই কথায় আমি বলব যে, যখন আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছি যেখানে তিনি নিহত হয়েছেন সেখানে গিয়ে আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করেছি যে, কীভাবে তিনি বসেছিলেন, কীভাবে খুনিরা ঘরে ঢুকেছিলেন। আরেকটা মজার জিনিস হল, যখন আমি ভারতে ভ্রমণ করেছি তখন আমি এটা জানতে খুব চেষ্টা করতাম যে, কীভাবে তারা ঘরে মেহমানকে আপ্যায়ন করে, ঘণ্টা-দুই ঘণ্টা ধরে। আমি তাদের সাথে কথা বলতাম। আমি চিন্তা করতে খুব পছন্দ করি। নানান স্থানকে পছন্দ করি।
ই.আ.: আপনি কি চিন্তায় বসবাস করেন?
মো.আ.: স্থান আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে, এখানে কী ঘটেছিল। স্থান মানেই হল স্মৃতির ভাণ্ডার। মানে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যখন আমি ভ্রমণ করেছি, আমি এভাবে বসেছি, আমি ভেবেছি যে, কীভাবে উনি বসে থাকতেন, কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু যখন চিৎকার করে উঠলেন কীভাবে তাঁর পরিবারের একজন ছুটে এলেন তাঁর কামরার দিকে? গুলি তাঁর শরীরের সাথে লেগে গেলে তিনি সিঁড়িতে ঢলে পড়েন। এটা আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে।আমি তাঁর ঘরে ঢুকেছি এটা দেখতে যে, কোথায় গুলি লেগেছে। তিনি যখন নিহত হয়েছেন সে মুহূর্ত তো তখন ছিল না। তবুও চিন্তার চেষ্টা করেছি। আপনি বইপোকাদের মতো, খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েন আপনি। চিন্তা করেন বইপোকাদের মতো খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লে কত কিছুর চিন্তা করতে হয়। এমন লোক তো চোখে ক্যামেরা লাগিয়ে রাখে। আমিও বইপোকাদের মতো। ক্যামেরা লাগিয়ে রাখি চোখে।
ই.আ.: আপনি যখন ভারতে ছিলেন তখন ভারতীয় সভ্যতা বা বাংলাদেশের সভ্যতা নিয়ে কোনো পড়াশুনা করেছেন?
মো.আ.: না। তবে আমি তখন খেয়াল করেছি বাংলাদেশের লোকজন জীবন নিয়ে খুব জেদি হয়। কোনো কাজ কত কঠিন তা তাদের কাছে ব্যাপার না। তা তারা করবেই। লক্ষ্যে তারা অটুট থাকবে। এটাই লক্ষ্য করেছি যে, কি ভারতে কি আরবে যুবকদের মধ্যে বাঙালিরা লক্ষ্যে অটুট।
ই.আ.: আপনি যখন ভারতে ছিলেন তখন কি বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন?
মো.আ.: না। মোটেই না। বিদেশি পত্রিকায় বাংলাদেশ নিয়ে যা বলা হত তার বাইরে আমি কিছুই জানতাম না।
ই.আ.: আপনার শৈশবের কিছু জানতেন না?
মো.আ.: শৈশবেও কিছু জানতাম না। আমি যখন দশ বছরের ছিলাম আমি পৃথিবীর নানা দেশ সম্পর্কে জানতে শুরু করেছিলাম। তখন বাংলাদেশ আমার কল্পনায়ও ছিল না। কিছুই জানতাম না আমি এ সম্পর্কে। জনাব মিজানুর রহমান আমাকে এদেশে আমন্ত্রণ না জানালে আমি কিছুই জানতাম না। না বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে জানতাম না ভারতে যখন ছিলাম তখন জানতাম। আর এ জন্য আল্লাহ্ কে ধন্যবাদ। আমি বাংলাদেশের মানুষের জন্য, শেখ হাসিনার জন্য, তাঁর দেশের ও পরিবারের জন্য ভালো কিছু করতে পেপেঁচি। আল্লাহ্ ই আমাদের সেই তৌফিক দান করেছেন।
ই.আ.: যখন আমি আপনার বই পড়েছি তখন দেখেছি আপনি ছাইভস্ম থেকে উড্ডীয়মান আগুনপাখির রখা বলেছেন। এমন চিন্তা আপনার মনে কী করে এল?
মো.আ.: আমি গ্রিক ট্রাজেডির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কল্পনা করেছি। কী ভাবে একজন ভদ্রমহিলা পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন শুধু তাঁর বোন শেখ রেহানা ছাড়া। তিনি তো আগুনপাখির সাথে তুলনীয়। কারণ তাঁরা দুজন তখন জর্মন মুলুকে ছিলেন। এটা চিন্তা করে দেখুন তো যে, একজন মহিলা যাঁর শত্রুরা হলেন জেনারেলরা, জামাআতে ইসলামী। তারা কিন্তু এর জন্য অনুতপ্ত নয়। একটু চিন্তাও করে না তারা যে, এমন একটি পরিস্থিতিতে কোনো মেয়ে বা কোনো ভদ্রমহিলা কীভাবে চুপ করে থাকতে পারেন? কীভাবে ক্ষত সারিয়ে তুলবেন? এই ভদ্রমহিলাকে আমার কাছে সম্পূর্ণ আশ্চর্যজনক বলে মনে হয়। আমি এখনও বুঝতে পারি না কীভাবে তিনি অপরাধীচক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, কীভাবে অটল ছিলেন নিজের অবস্থানে। অবাক হই, যেভাবে খুনিরা তাঁর পিতাকে, তাঁর পরিবারকে খুন করেছে সেভাবে তিনি ন্যায়বিচারের তরবারি নিয়ে প্রতিশোধ নেন নি। অথবা সেনাবাহিনীর যেসব লোক তাঁর পিতাকে খুন করেছেন সেভাবে তিনি তাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করেন নি। অথবা, তাদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধও ঘোষণা করেন নি। এটাই তো বাঙালি নারীদের মাহাত্ম। যেখানে বিচার নেই সেখানে তাঁরা আসমানি বিচারের জন্য অপেক্ষা করেন। আমার আমার এই বইয়ে ও আমার আলোচনাতেও এ কথা বলেছি যে, যদিও শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো বড়ো ছেলে ছিল নাবরং তাঁর বড়ো সন্তান ছিল কন্যা যিনি বাংলাদেশের ইতিহাসকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন এই অর্থে যে, নারীরা, স্ত্রীরা কিংবা মাতারা নিজের অধিকার আদায়ের জন্য স্বামী-পিতা-সন্তানের যারা খুনি তাদের বিরুদ্ধে অটল থেকে কী করতে পারে তা করে দেখিয়ে দিয়ে। আর, সেখানে আমরা ছেলেরা খুনিদের সাথে দরদস্তুর করি। আমাদের মিসরে একজন রাজা ছিলেন তাঁর নাম ফারুক। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হলে তিনি পিতৃপুরুষের সিংহাসন বাঁচাতে কিছুই করলেন না। ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় অ্যাডওয়ার্ডের কথা তো আমরা সবাই জানি। যখন তিনি একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেললেন ও তাকে বিয়ে করার জন্য অটল থাকলেন তখন তাকে বলা হল যে, যদি মেয়েটিকে বিয়ে কর তবে তোমাকে সিংহাসন ছেড়ে দিতে হবে। অ্যাডওয়ার্ড কিন্তু সিংহাসন ছেড়ে দিলেন এবং মেয়েটিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মেয়েরা হলে এমনটা করত না।
ই.আ.: কীভাবে আপনার কাছে মনে হল যে, আমাদের দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একটি কাল্পনিক চরিত্র?
মো.আ.: এটা তো আমি আপনাকে আগেই বলেছি। একটু কল্পনা করে দেখুন না যে, একজন নারী তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়েছেন—মানবী হিসেবে তাঁকে নিয়ে ভাবতে কেমন লাগবে আপনার? তাঁর সমস্ত অনুভূতি, হৃদয় দলিত মথিত হয়েছে। ভাবুন তো, পিতামাতা, ভাই, শেখ মুজিবুর রহমানের নাতি সবাইকে হারিয়ে এই মানবীর মানসিক পীড়ার কি চূড়ান্ত ছিল! অন্য কোনো নারীকে তাঁর আসনে ভেবে দেখুন তো একবার। এমনকি, যখন আপনি তাঁর চোখ দুটোর দিকে তাকাবেন দেখবেন তাঁর দুই চোখে আজব দৃষ্টি খেলা করছে, আজব দৃঢ়তা তাঁর দুচোখ জুড়ে। এমনকি, ত্রিশ কি চল্লিশ বছর ধরে তাঁর চোখে আমি একই দৃঢ়তা দেখে আসছি। তাই তিনি পৌরাণিক চরিত্র। দুঃখ-কষ্ট থেকে তিনি উঠে এসেছেন, ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু থেকে তিনি উঠে এসেছেন, লক্ষ লক্ষ মা-বোন যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের হাতে ধর্ষিত হয়েছিল সেখান থেকে তিনি উঠে এসেছেন। অথচ তিনি হার মানেন নি। এজন্যই তিনি পৌরাণিক চরিত্র।
ই.আ.: আচ্ছা। আপনি আমাকে আগে বলেছিলেন যে, আরবিতে শেখ হাসিনা বা বাংলাদেশ নিয়ে কোনো বই নেই।কেন বলেছিলেন এ কথা?
মো.আ.: আস্ত একটা বই তো দূরের কথা। বাংলাদেশের ইতিহাস-সভ্যতা নিয়ে আরবি ভাষায় একটা শব্দও এর পূর্বে লেখা হয় নি। জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতায় এটা হয় নি। কী হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সাথে, তাঁর পরিবারের সাথে কেউ তা জানে না। কীভাবে তিনি সর্বস্তরের জনগণের নেতা হয়েছিলেন কেউ তা জানে না। তাঁকে আল্লাহ্ এমন এক কন্যা দান করেছেন যার ভেতরে পিতার আত্মা, দৃঢ়তা, একাগ্রতা প্রবেশ করেছে। আমার বইয়ের আমি বলেছি যে, পিতার থেকে এসব তাঁর ভেতরে প্রবেশ করেছে।
ইআ.: আপনার বই পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, আপনার বর্ণনা কাব্যধর্মী। বই পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছি কোথাও আমি ফিল্ম দেখছি, কোথাও-বা গল্প পড়ছি বা পুরাণ পড়ছি। লেখার এই যে পদ্ধতি এটা কি আপনি আপনার অন্য বইয়ে ব্যবহার করেছেন?
মো.আ.: সবসময় তো আমি প্রবন্ধ লিখি। কলাম লিখি মাঝে মাঝে। আমি আপনাকে বলব যে, কলাম বা প্রবন্ধ যাই লিখি না কেন সব আমার অশ্রু দিয়ে লেখা। কারণ আমি আমার পাঠককে যখন কিছু জানাই তখন চেষ্টা করি যেন কবিতার ভাষায় জানাই। আর আমি তো ঘটনার মধ্যেই বসবাস করি।
তবে আমার নিজেকে সফল মনে হচ্ছে। কারণ, আপনি আমার পাঠক ও পড়ে আপনি এমনটা বললেন। শব্দ দিয়েই আমি চাই কল্পনাকে বুনতে।
ই.আ.: হাসিনা : হাকাইক ওয়া আসাতির এই বইটির প্রচ্ছদের ওপর লেখা আছে আপনার আরও দুটো বই প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। সেগুলো নিয়ে কিছু বলবেন?
মো. আ.: সে দুটো বই আমি প্রায় লিখে ফেলেছি। ছাপানোর জন্য আমি প্রায় প্রস্তুতও করে ফেলেছি। এর একটি বই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর। অন্যটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তা নিয়ে। এটিও আরবি ভাষায় প্রকাশিত হবে। গণহত্যার যারা বলি হয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের কয়েক জনের সাথে আমি দেখা করব ইনশাআল্লাহ্। কীভাবে এই জঘণ্য ঘটনাগুলো ঘটেছিল তা শুনব। তাদের সাথে গণহত্যা ও ধর্ষণের স্থান পরিদর্শন করব।
ই.আ.: ঢাকাতে হবে?
মো.আ.: ঢাকাতেও হবে, গ্রামেও হবে। এই বইটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই হবে যা আমি পরে ইংরেজিতে অনুবাদ করব। এখন আমি হাসিনা : হাকাইক ওয়া আসাতির ইংরেজীতে অনুবাদ করছি। মুসলিম ভ্রাতৃত্ব নিয়ে আরও একটি বই লিখেছি আমি। কীভাবে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের শুরু হল, কীভাবে তারা ক্ষমতায় আসার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠল, কীভাবে মিসরীয়দের জাতীয়তা পরিবর্তনের চেষ্টায় লিপ্ত হল সেসব এই বইয়ে আছে।
ই.আ.: আচ্ছা, আপনি আমাকে আগে বলেছিলেন যে, আপনি রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে বই লিখেছেন। সে বই সম্পর্কে কিছু বলেন আমাকে?
মো.আ.: সেই বই পরে আর বেরোয় নি। পরে আমি কা মুসলিম ভ্রাতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত করেছি। সে বইটাই রাজনৈতিক ইসলাম ছিল।
ই.আ.: আচ্ছা, আপনি কি ভারত বিভাজন নিয়ে উৎসাহী ছিলেন? এই বিষয়ে লেখা কোনো বই পড়েছেন?
মো.আ.: না। ভারত বিভাজন অর্থাৎ ভারত থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভাজন নিয়ে আমি উৎসাহী নই। আমি রাজনৈতিক লেখক নই। আমি মানবিকতার দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পছন্দ করি।
ই.আ.: অল্প কিছু দিন পূর্বে হাসিনা : হাকাইক ওয়া আসাতির বইটি বাংলায় অনূদিত হয়ে বেরিয়েছে। এই প্রকাশনাকে কীভাবে দেখছেন আপনি?
মো.আ.: বাংলায় অনূদিত হয়েছে জেনে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু মোটের ওপর আমি বেশ অখুশি। কারণ, ঐ অনুবাদ লেখকের অনুভূতির সাথে বিশ্বস্ত থাকে নি। আমার মনে হয়েছে, তাতে আমার বইয়ের কিছু কিছু বাক্যের অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে। আর কয়েকটি পৃষ্ঠা আছে সেখানে যেগুলোর অনুবাদ বেশ দুরূহ। বই অনুবাদ হয়েছে তাতে আমি খুশি। কিন্তু অনুবাদকরা যা করেছেন তাতে আমি খুশি হই নি।
ই.আ.: গ্রন্থস্বত্ত্ব নিয়ে আপনার কিছু বলার আছে কি?
মো.আ.: জি। একটা ব্যাপারে আমি খুব অবাক হয়েছি। তা হল, অনুবাদকরা আমার বইয়ের গ্রন্থস্বত্ত্ব তাঁদের নিজেদের বলে দাবি করেছেন। এটাকে আমি নীতি-বহির্ভূত বলে মনে করছি।
ই.আ.: এখন আমাদের আলোচনা শেষ করছি। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
মো.আ.: আমিও খুশি হয়েছি যে আমি বাঙালি জনগণের জন্য কিছু বলতে পারলাম। ধন্যবাদ।