মসলার মসলামাখানো আদিগল্প

মসলা যেমন বাঙলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান তথা ভারতীয় উপমহাদেশের খাবারের রসনাগুণ বাড়িয়েছে বহু গুণ তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসে যোগ করেছে মসলাদার অনেক গল্প। মসলা আমাদের জিভের স্বাদ বাড়িয়েছে ঠিকই কিন্তু আরব ও ইয়োরোপের জনগোষ্ঠীকে দিয়েছে কাড়ি কাড়ি টাকা, ঘর থেকে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার দুর্নিবার ইচ্ছা এবং সর্বোপরি সুস্বাদু গল্পের স্বাদ। ইতিহাসের মসলামাখানো এসব গল্প হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। শুধু এখন নয়, এসব গল্প আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়েও তাঁদের কাছে ছিল অজানা। মসলা তাঁদের অজানায় থেকে তাঁদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ইতিহাসে ঘটিয়েছে প্রলয়ঙ্করী কাণ্ড।

প্রাচীন ইরাকের হেঁশেল থেকে শুরু করে মিসরের পিরামিডের অভ্যন্তর পর্যন্ত ছিল এই মসলার জয়জয়কার। মসলার জাদুতে তখন ইয়োরোপ আর মধ্যপ্রাচ্য সরগরম। এই মসলাকে কেন্দ্র করে ব্যাবসা-বাণিজ্য শুরু করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে ইয়োরোপের বেনিয়ারা। মারামারি, হানাহানি, রাজ্যদখল এসব তো ছিল পৃথিবীর নিত্যকার মসলামাখানো ঘটনা। আর আমাদের পূর্বপুরুষরা নিশ্চিত মনে রান্নাঘর আর খাবারের মজমায় মসলার গুরুত্ব জেনেই শুধু চুপচাপ বসে ছিল।

শুধু হাল আমলে নয় অতীতেও ভারতীয় উপমহাদেশে উৎপাদিত হত পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজনীয় সিংহভাগ মসলা। শুরুর দিকে ভারতের এই মসলার ব্যাবসা পুরোপুরি মধ্যপ্রাচ্যদেশীয় আরব ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর দখলে ছিল। ২০০০ ঈস়াপূর্ব সনেও ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে তারা সবচেয়ে বেশি মরিচ ও দারুচীনী রপ্তানী করত। মিসরের হায়ারোগ্লিফি লিপিতে উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা পিরামিডের নির্মাণশ্রমিক ছিল তাদের শারীরিক শক্তি ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে পেঁয়াজ ও রসুনসেবনের ব্যবস্থা ছিল। এছাড়াও, ১৪৫৩ ঈস়াপূর্ব সময়ে ইয়ুনান তথা অধুনা গ্রীস়ের লোকেরা বনাজি চিকিৎসায় ৪০০ রকমের লতাগুল্ম ও মসলার ব্যবহার করত। এসব লতাগুল্মের সিংহভাগই আমদানী হত ভারত থেকে।

দজলা-ফ়োরাতের দেশ হিসেবে কথিত এবং অধুনা ইরাকস্থ মেস়োপটেমীয়া ও আশুরীয় সভ্যতার লোকেরা খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করতে মসলার ব্যবহার যেমন করত তেমনি বিভিন্ন রোগব্যাধী থেকে শেফ়া লাভ করতে নিয়মিত মসলার ব্যবহার করত।

মিসরীয় ফারাওদের মৃতদেহ মমীকরণে প্রয়োজনীয় রসায়নের অন্যতম উপাদান ছিল এই মসলা যা তারা ফিনিশীয় বণিকদের কাছ থেকে চওড়া দামে কিনে নিত। এই ফিনিশীয় বণিকদের মাতৃভূমি ছিল শামদেশ বলে কথিত স়ুরীয়া, উর্দুন, লুবনান ও ইস়রায়েল এবং তাদের প্রথম ও প্রধানতম ব্যবসায়িক পণ্য ছিল ভারত ও চীনের নানাবিধ মসলা ও লতাগুল্ম।

ধর্মে কথিত আছে যে, স়াবার রানী বালকিস় হজ়রত স়োলায়মান (আ)-এর কাছে যে উপঠৌকন নিয়ে আসেন তার মাঝে ছিল ১২০ রতল বা পাউণ্ড স্বর্ণ, মসলা ও জহরত। ইয়াহুদীদের কেতাব বেরেশীত (בְּרֵאשִׁית) তথা আদিপুস্তক (অধ্যায় ৩৭:২৫)-এ উল্লেখ আছে যে, হজ়রত ইয়ুসু়ফ় (আ)-কে তাঁর ভাইরা যে বণিকদলের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল তাদের সবাই ছিল মসলার ব্যবসায়ী। এছাড়াও, ইয়াহুদীদের আরেক উল্লেখযোগ্য কেতাব শীর হাশ-শীরীম (שִׁיר הַשִּׁירִים) বা পরমগীত (অধ্যায় ৪)-এ ভারতের উল্লেখযোগ্য মসলার তুলনামূলক বিবরণ চোখে পড়ে।

বিশ্ববিশ্রুত সুন্দরী ক্লিয়োপেত্রা—যিনি মিসরের সম্রাজ্ঞী ছিলেন—তাঁর নামে কথিত আছে যে, তিনি রোমীয় সম্রাট কায়স়ার তথা স়িজ়ারকে খাবার খাইয়ে মুগ্ধ করতে রান্নায় জাফ়রানের ব্যবহার করেন।

২০০ ঈস়াপূর্ব সাল থেকে ১২০০ ঈস়ায়ী সাল পর্যন্ত রোমীয়দের দখলে থাকে ভূমধ্যসাগরের শাসনভার। তখন থেকেই তারা মসলার গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং ভারতে যাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকে। মসলার সন্ধানে তখন একটি প্রধান মার্গ বা পথ বা উপায় লোকেদের জানা ছিল আর তা হল মিসর থেকে ভারত পর্যন্ত দ্বিবৎসরব্যাপী লোহিত সাগর ও আরব সাগর হয়ে সমুদ্রযাত্রা। এই পথ ছিল অত্যন্ত ক্লান্তিকর, পরিশ্রমসাধ্য ও শ্বাপদসংকুল।

ধীরে ধীরে দক্ষিণ ইয়োরোপ থেকে স়ামারকান্‌দ্ হয়ে মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে মরুপথ ও পার্বত্যপথে এক উপায় বা পথ বের হয়। এই পথ চীন হয়ে পরবর্তীতে জাভা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। প্রথমে এই পথ মসলার মার্গ নামে পরিচিতি পেলেও পরে তা রেশমমার্গ নামেই পরিচিত হয়।

নীল রঙের পথটি মসলা ব্যাবসায়ের সামুদ্রিক পথ আর লাল রঙের পথটি রেশমমার্গ Image Source: Wikimedia Commons

রোমক শাসন আমলে মসলার কারবার যারা করত তারা যাচ্ছেতাই দাম রাখত। ফলশ্রুতিতে মসলার দাম প্রায়শই স্বর্ণের দামকে ছুঁই ছুঁই করত। এতে আরবদের অনেকে রাতারাতি বিত্তশালীতে পরিণত হয়। এছাড়াও, রাজপরিবারে মসলার কদর বেড়ে যায় এবং মসলা রাজদ্রব্য বা শাহী বস্তুর কদর পায়। Nero fiddled when Rome burned এই প্রবাদখ্যাত সম্রাট নিরুর অভিষেক অনুষ্ঠানে সম্রাটের পক্ষ থেকে রোমের সড়কে সড়কে প্রজাদের মাঝে জাফ়রান বিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও, নিরুর স্ত্রীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ধূপধুনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল রোম সাম্রাজ্যের প্রায় এক বছরের জন্য মজুদকৃত দারুচীনী।

আরব বণিকরা কখনও সাধারণ জনগণকে মসলার প্রাপ্তিস্থল সম্বন্ধে কিছু বলত না। মসলা সম্পর্কিত সব কিছুর ওপর তারা রহস্যের পর্দা টেনে রাখত। সাধারণ মানুষের মনে মসলা ও মসলাকে ঘিরে অনেক রহস্য বিরাজ করত। মানুষ ভাবত, বুঝি রহস্যময় মসলার দেশে পৌঁছানোর সাধ্যি মানুষের নেই।

____________________

দোহাই