দারুচীনী পুরাণের হাতছানি
সুপ্রাচীনকাল থেকে মসলা মানুষের অর্থনীতিকে সাজিয়েছে, রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের পদ্ধতিতে কলকাঠি নাড়িয়েছে মসলা। ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এ মসলা-ব্যবসায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য কখনওই এ অঞ্চলের লোকেদের কাছে ছিল না। বরং সে একচ্ছত্র আধিপত্য শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যদেশীয় আরবদের হাতে ছিল। আরবদের এই ব্যাবসা শুধু এতদঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা জাভা, সুমাত্রা এসব দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখান থেকেও মসলা সংগ্রহ করতে শুরু করে।
মসলা-ব্যবসায় আরবদের মাঝে ধনী হওয়ার প্রধান উপায় হিসেবে অনুভূত হয় এবং তারা এ কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তারা বিভিন্ন জায়গার মসলার গুণ বিচার করে ভালো জাতের মসলার সমাগম বাড়াতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জায়ফল—যা আমরা মাংসরান্নায় প্রচুর ব্যবহার করছি—সেটা তারা ইন্দোনেশিয়ার মালুকূ দ্বীপপুঞ্জ১ থেকে সংগ্রহ করে ভারতসহ তাদের সব ব্যবসায়ের অঞ্চলগুলোতে চালু করে। তাদের সংগৃহীত উল্লেখযোগ্য মসলার মাঝে ছিল এলাচ, দারুচীনী, লবঙ্গ, গোলমরিচ, আদা, হলুদ ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হল, শুরুতে আরবরা আরবীতে এই মসলার কোনও সাধারণ নাম দিতে পারে নি। শুরুতে আরবরা মসলাকে বাহাারাত্ (بهارت) বা ভারত নামেই ডাকত।
আরবরা যেসব মসলার ওপর খুব গুরুত্ব দিত সেগুলোর বেশীর ভাগই ছিল সুগন্ধীজাতীয়। ব্যাবসার সুবিধার্থে এদের নিয়ে অনেক গল্প চালু হয়ে যায় মানুষের মুখে মুখে। এদের প্রতিটি গল্পই মসলামাখানো, বানোয়াট। মসলার সাথে জড়িয়ে থাকত এক হারানো স্বর্গের গল্প, এক স্বর্গীয় সুগন্ধীর গল্প। তখনকার ইয়ুরোপীয়দের কাছে দারুচীনীর বেশ সমাদর ছিল এবং প্রাচীন ইয়ুরোপের প্রায় সর্বত্র দারুচীনী ব্যবহৃত হত। বিশেষ করে, পুরো ইয়োরোপ জুড়ে শীতকালে মাংস সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষকদ্রব্য (preservative) হিসেবে দারুচীনী ব্যবহৃত হত। রোমের প্রায় প্রতিটি গৃহে ধূপধুনার পাশাপাশি দারুচীনী পোড়ানোর প্রচলন ছিল। একই সাথে মদে রুচিবর্ধক সুগন্ধ যোগ করতে ব্যবহৃত মসলার মধ্যে দারুচীনী ছিল অন্যতম।
রোমক সম্রাট নিরুর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল পোপ্পায়েয়া সাবিনা। ঈস়ায়ী ৬৫ সনে রাগের বশবর্তী হয়ে সম্রাট তাঁর এই স্ত্রীর তলপেটে লাথি মারেন যার ফলে স্ত্রীর ভবলীলা সাঙ্গ হয়। এমন ঘটনায় সম্রাট নিরু বিবেকের দংশনে জর্জরিত হন এবং প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ স্ত্রীর মরদেহ না পুড়িয়ে মিসরীয় পদ্ধতিতে তা দারুচীনী দিয়ে সুবাসিত করে এক বছরের ব্যবহৃত দারুচীনী পুড়িয়ে শবমিছিলের আয়োজন করেন।
দারুচীনী এতই মূলবান ছিল যে, তা সম্রাটের জন্য প্রেরিত মহার্ঘ্য উপঠৌকনে পাঙ্কতেয় ও দেবতার নৈর্বেদ্য হিসেবে প্রাচীন ইয়ুনানে ব্যবহৃত হত। মীলেতোসের আপোলো মন্দিরে দারুচীনী ও সিনামন দেবীর প্রতি উৎসর্গকৃত হত। ইয়ুনানীরা এই দারুচীনীর সন্ধান পেয়েছিল ফিনিশীয়দের কাছে। ইয়ুনানী কবি সাপফো ও ইতিহাসবেত্তা হেরোদোতোস দারুচীনী সম্বন্ধে লিখেছেন।
হেরোদোতোস সম্ভবত ৪৫৪ ঈস়াপূর্ব সনের আগে বা পরে মিসর ও পরে লেবাননের সূর (صور) হয়ে বাবেল বা অধুনা ইরাক পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। এর পূর্বে তিনি খিস্তোরীয়াই (Ἱστορίαι) ইতিহাসনিচয় নামে নয় খণ্ডের একটি পুস্তক রচনা করেন যার তৃতীয় খণ্ডটি থালিয়া নামে অভিহিত।
এখানে তিনি ভারতবর্ষকে পৃথিবীর পূর্বাংশের সর্ব দূরবর্তী সীমা হিসেবে উল্লেখ করে ধনসম্পদে প্রাচুর্যময় অঞ্চল বলে অভিধা দিয়েছেন। থালিয়া পুস্তকে তিনি আরবদের ব্যবসায়িক বিভিন্ন পণ্যের উল্লেখযোগ্য বিবরণ প্রদান করেন এবং আরবদের কর্তৃক বহুল প্রচারিত এক মসলামাখানো মুখরোচক দারুচীনী পুরাণের বর্ণনা করেন। তাঁর বর্ণনা অনুসারে “দক্ষিণের সব জনবহুল দেশের মধ্যে আরাবীয়া ছিল সর্ব দূরবর্তী: এবং একমাত্র এ দেশই লোবান, গন্ধরস, কেসিয়া, সিনামন ও মাস্তিক গঁদ উৎপাদন করে। গন্ধরস ব্যতীত বাদবাকি সব কয়টি আরবদের জন্য আয়াসলব্ধ নয়। ফিনিশীয়রা এলা (ইয়ুনানকে গ্রীক ভাষায় এলা বলা হয়)-তে যে স্তোরাখ নিয়ে আসে সে স্তোরাখ পুড়িয়ে লোবান সংগ্রহ করে তারা; লোবান পেতে তারা এটা পোড়ায়। কারণ মসলাবাহী বৃক্ষগুলো নানা বর্ণের ছোটো ছোটো সপক্ষ সর্পবেষ্টিত হয়ে প্রহরায় থাকে, প্রতিটি বৃক্ষের চারপাশে এমন প্রচুর সাপ থাকে; মিসরকে এই সাপগুলোই আক্রমণ করে। স্তোরাখের ধুম্র ব্যতীত অন্য কিছু এই সাপগুলোকে গাছ থেকে তাড়াতে পারে না। আরবরা আরও বলে যে, পুরো দেশ এই সাপগুলো দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যেত যদি এমনটা করা না হত, আমার বিশ্বাস বিষধর সাপগুলোর সাথে এমনটা করা না হত।“ [থালিয়া, অধ্যায়: ১০৭] “… যদি আরাবীয়ার বিষধর ও সপক্ষ সর্পগুলো অবশিষ্ট সাপের মতো স্বাভাবিকভাবে জন্মাত তবে মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে যেত; কিন্তু … সঙ্গমরত অবস্থায় যেই পুরুষ সাপটি তার বীর্যস্খলন করে সাথে সাথে স্ত্রী সাপটি সেটির ঘাড় কামড়ে ধরে মেরে ফেলে। পুরুষ সাপের সাথে এমন আচরণ করার প্রেক্ষিতে স্ত্রী সাপটি অনুশোচনায় ভোগে এবং পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে মায়ের পেটের অভ্যন্তরে থাকা অবস্থায় বাচ্চাটি মায়ের নাড়িবুড়ি কামড়াতে থাকে এবং সেসব কামড়ে খেয়ে ফেলে মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে আসে। অন্য সাপ যেগুলো মানুষের ক্ষতি করে না সেগুলো ডিম ফুটিয়ে অসংখ্য শাবকের জন্ম দেয়। আরবের সপক্ষ সর্পগুলোর ক্ষেত্রে তদ্রূপ না হয়ে বর্ণিত উপায়ে বংশবিস্তার ঘটে এবং এ প্রজাতি অন্যত্র দুষ্প্রাপ্য।“ [থালিয়া, অধ্যায়: ১০৯]
এরপর তিনি কেসিয়া ও সিনামন প্রাপ্তির বর্ণনা প্রদান করেন। কেসিয়া হল এক ধরনের গাছের বাকড় যা পুরু ও কটু গন্ধবিশিষ্ট হত এবং ইয়ুনানের সর্বত্র তা নিম্নমানের সিনামন হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। এর বৈজ্ঞানিক নাম Cinnamomum cassia। এই কেসিয়াই বর্তমান পর্যন্ত বহুল ব্যবহৃত দারুচীনী যার উৎপত্তিস্থল ও নামকরণ সম্বন্ধে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। সিনামনও অন্য এক ধরনের গাছের বাকড় যা পাতলা ও মিষ্টি গন্ধবিশিষ্ট হত। এই সিনামন কেসিয়ার তুলনায় দামী ছিল ও ইয়ুরুপে তা সত্য দারুচীনী (C. Verum) হিসেবে মূল্য পায়। যেখানে সাধারণ লোকেরা সিনামন কিনতে পারত না সেখানে কেসিয়া তাদের কাজে লাগাত।
থালিয়া পুস্তকের বর্ণনা মতে কেসিয়া ও সিনামন নিম্নোক্ত উপায়ে প্রাপ্ত হত: “যখন তারা কেসিয়ার জন্য বের হয় তখন দুচোখ ছাড়া পুরো শরীর ও মুখে ষাঁড়ের চামড়া বা অন্য পশুর চামড়া বেঁধে নেয়। কেসিয়া সাধারণত একটি অগভীর হ্রদে জন্মায় যার চারপাশে ও যার ভেতরে বাদুড়ের মতো পক্ষল জীবরা বসবাস করে যেগুলো বাদুড়ের মতো তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকাডাকি করে ও দুর্গম প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে রাখে। কেসিয়া সংগ্রহ করতে সেগুলোকে চোখের সামনে থেকে দূর করতে হয়। সিনামনের সংগ্রহ বৃত্তান্ত বেশ অদ্ভুত। কোথা থেকে এই সিনামন আসে এবং কোন দেশই-বা তা উৎপাদন করে তারা তা বলতে পারে না। তারা ইঙ্গিত করে এমন এক দেশের যেখানে বাক্ষস Bacchus (রোমকদের আসবদেবতা) লালিতপালিত হয়েছেন। বড়ো বড়ো পাখি এসব শুকনো কাঠের টুকরো বহন করে নিয়ে যায় তাদের বাসায়। ফিনিশীয়দের থেকেই আমরা এই শুকনো কাঠের টুকরোর নাম পেয়েছি সিনামন। অনেক অনেক উঁচুতে যেখানে মানুষের আরোহণ অসম্ভব সেখানে এ পাখিরা কাদামাটির সাহায্যে কাঠের টুকরোগুলো গেঁথে দিত। সুতরাং এই কাঠ সংগ্রহ করতে আরবদের বেশ কৌশল অবলম্বন করতে হত। ষাঁড়, গাধা ও অন্য ভারী জন্তু যেগুলো আরবদের দেশে মরে যেত সেগুলো কেটে সেগুলোকে সম্ভাব্য বড়ো টুকরো টুকরো করে তারা পাখিদের বাসাসংলগ্ন স্থানে ফেলে রাখত। বড়ো বড়ো পাখি মাংসের এসব বড়ো বড়ো টুকরো ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়ে নিজেদের বাসায় রাখত। এসব মাংসের ভার বহন করতে পারত না পাখিদের বাসা। ফলে সেগুলো নিচে পড়ে যেত। আরবরা পতিত কাঠগুলো সংগ্রহ করে অন্যান্য দেশে বিক্রির জন্য নিয়ে যেত।” [থালিয়া, অধ্যায়: ১১০-১১১]
এ গল্পগুলো নিঃসন্দেহে কেবল গল্প। আর অনেক কারণে এগুলো বিশ্বাস-অযোগ্য। এ কথা প্রশংসনীয় যে, হেরোদোতোস দারুচীনী ও সত্য দারুচীনীর মধ্যে পার্থক্য করতে পেরেছিলেন। কিন্তু একচেটিয়া ব্যাবসা পাকাপোক্ত করতে আরবদের বানানো দারুচীনী পুরাণের সত্য-মিথ্যা নিরুপণ করতে পারেন নি। ইয়ুনানী দার্শনিক থেওফ্রাসতোস এবং ইতিহাসবেত্তা ও ভূগোলবিদ আগাথারখীদেস নিজেদের লিখিত বর্ণনায় পূর্বোক্ত পুরাণেরই বর্ণনা করেছেন। এমনকি প্রাণীর অনুসন্ধান (Τῶν περὶ τὰ ζῷα ἱστοριῶν) নামক পুস্তকে দার্শনিক আরাস্তু দারুচীনী পাখি নামের একটি কাল্পনিক পাখির নাম লিপিবদ্ধ করেন যা পরবর্তীতে আগুনপাখি নামেও কথিত হয়।
আরব বেনিয়াদের এই চটকদার গল্প রোমীয় দার্শনিক জ্যেষ্ঠ প্লিনি (Pliny the Elder) কর্তৃক অস্বীকৃত হয়। লাতিন ভাষায় লিখিত তাঁর Naturalis Historia বা প্রকৃত ইতিহাস নামক কেতাবের অষ্টম খণ্ডের অধ্যায় ৪২-এ দারুচীনী সংগ্রহের এ গল্প পুরো বানোয়াট বলে দাবী করে বলেন যে, দাম বাড়ানোর জন্যই আরবরা এমনটা করে। অবশ্য পরের অংশে তিনি নিজেই অন্য একটি গল্প জুড়ে দিয়ে দারুচীনী গাছ ইথিয়োপিয়ায় জন্মায় বলে উল্লেখ করেন।
জ্যেষ্ঠ প্লিনির বর্ণনা থেকে কেসিয়া ও সিনামনের দাম নিয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। রোমীয় ১ পাউণ্ড ভর ৩২৭.৪৫ গ্রাম ভরের সমান হয়। জ্যেষ্ঠ প্লিনির বর্ণনা হতে দেখা যায়, প্রতি পাউণ্ড কেসিয়ার মূল্য ১০ দেনারি আর প্রতি পাউণ্ড সিনামনের মূল্য ১০০০ দেনারিরও অধিক। রোমক সম্রাট দিয়োক্লেতিয়ান (Diocletian) কর্তৃক ৩০১ ঈস়ায়ী সনে প্রবর্তিত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সর্বাধিক দাম নির্ধারক রাজাজ্ঞায় দেখা যায় কেসিয়ার দাম ১২০ দেনারি/পাউণ্ড যেখানে একজন ক্ষেতমজুরের পারিশ্রমিক ২৫ দেনারি/দিন। এখানে উল্লেখ্য যে, দেনারি হল রোমীয় রৌপ্যমুদ্রা।
দারুচীনী পুরাণের এই গল্প মধ্যযুগেও লোকেদের মুখে মুখে ছিল। অতিপ্রসিদ্ধ এই দারুচিনি দ্বীপের আখ্যানের সাথে সাথে এ নিয়ে অন্যান্য আখ্যান ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলত এই দারুচীনী নীলনদের উৎসের কাছে জালে ধরা পড়ত। কিন্তু এই দারুচীনী যে শ্রীলঙ্কা, ভারত, বাঙলাদেশ হতে সংগৃহীত হত সে সত্য কখনও কেউ প্রকাশ করত না। এতে ইয়োরোপের বেনিয়াদের মনে অনুভূত হতে থাকে রহস্যের দারুচীনী দ্বীপে যাওয়ার পথ আবিষ্কারের গুরুত্ব।