এগারোটি কাঠগোলাপ
কলাপাতারঙা টিপ কপালে,
কানে ঝুমকাজবার দুলে,
হাতের কবজিতে বকুলের বালা জড়ায়ে,
মাথায় মেঘের টিকলি দিয়ে,
আর চুল ছেড়ে দিয়ে
সে বালিকা ঘুরতে গেছে
ঝাউবাগানের পাতালে।
কলাবতীফুল দেখিয়ে বলল—
“দেখো, কী সুন্দর ফুল!”
আমার দৃষ্টি ছিল মিনজুরিগাছের
ডালটির দিকে।
আমি বললাম―“তুমি আজ
নূপুর পায়ে দাও নি কেন?”
ও বলল―“ওদের দেখতে
এসেছি জেনে গেলে
দোপাটিরা ঝরে যাবে। তাই―”
“আমি কেমন করে জানব
তুমি আমার সাথে আছ?”
তিনটি সেগুনফুল দিয়ে একটি
নাকফুল গড়ে আমি ওকে দিয়েছি।
এ অলঙ্কার ও নিল না।
বলল―“তুমি অভিমান করেছ কি?”
আমি চুপটি করে রইলাম।
এর পরদিন আর দেখা হল না।
একবিকেলে পাহাড়ের কোণে
বেশ মেঘ করেছিল।
সেই মেঘেদের সাথে কথা কইছিলাম―
“আমি তোমাদের বন্ধু হতে পারি?”
ওরা বলল―“তুমি তো উড়ে বেড়াতে পার না।”
বললাম―“কে বলেছে! আমি ওই দাসুসাহিক্ষেত
অবধি উড়ে যেতে পারব।”
“তুমি যে দিগধাউড়ি নও।”
পেছনে কোথায় যেন নিক্বণ বাজে;
দেখলাম সেই বালিকাটি আসছে,
নাকে তার সেগুনফুল।
কলাপাতারঙা শাড়িতে
তার তনুলীলা যেন ফুটে উঠেছে।
মেঘেরা কানে কানে বলল―
“তোমার চোখ কি এ যাবত ওকেই খুঁজেছে?”
একটা কাঠবাদামগাছের পাতার আড়ালে
ও চোখ লুকিয়ে উঁকি দিচ্ছিল
চুপিসারে। আমি সামনে গিয়ে
বললাম―“তোমার ঠোঁটে আজ চুমু খাব।”
একনিবিষ্ট হয়ে শুনল ও কথা।
পরিযায়ী মেঘেদের মিসকালো পাখনায়
নিঃসঙ্গতা নিবিড় হয়ে এলে
ভ্রুলতামধ্য টিপখানি খসে পড়ে।
বঞ্চিত করেছে পৃথিবী আমাকে
বাসন্তীরঙা পাতার মতো
পাতাঝরা বৃক্ষের প্রতিনিধি করে।
কেন এমন হয়?
ঘটনা কেন ঝরে যেতে চায় স্মৃতি হতে?
জলপ্রপাতের একহাঁটু জলে
পাথরগুলি, আর আমি, আর প্রিয়ান্তা―
মন্দীভূত হয়ে আসা ভালোলাগা।
নিকটে একটা ঝোঁপে কাঁঠালচাঁপা পাকবে বলে
সেই কবে থেকে বিরক্ত হয়ে আছে।
মেঘের প্রথম জলকণা পড়ল
কাঁঠালচাঁপার কুঁড়ি বেয়ে।
সোঁদা গন্ধের সে কী উষ্ম তন্ময়তা!
সুঘ্রাণ ছড়ায়ে বশ করেছে আমাকে
বৃষ্টির ফোঁটা ভেজা হাওয়ায় ভর করে।
তখনই দেখেছি আজানুপ্রসারিত চুলবুলে চুলে
অনাস্বাদিত শ্রাবণের অনাকাঙ্ক্ষিত ঢেউ।
তাকে বলতে ভুলে গেছি,
সৌজন্যবোধেও জিজ্ঞেস করি নি―“কেমন আছ?”
মনোরমা শৈলী যখন বৃষ্টিতে ভিজেছিল
স্বেচ্ছায়―
বাড়ির পেছনের কলাপাতা হতে
বৃষ্টির পানি যেমন থেকে থেকে ঝরে
তেমন লেগেছিল আমার কাছে
ওর শাড়ির দেহ।
নির্ধারিত নির্জনে ঝরনা ঝরছে,
বৃষ্টি নিমন্ত্রণ করছে আমায়―
পান্থপাদপের প্রত্যন্ত ভিজে পাতায়
এসে স্নাত হয়ে যাও নিমগ্ন ভালোবাসায়।
সুতরাং, একদিন জানতেও পারবে না―
এই আমিটাই হয়তো কোনও মানসীর হৃদয়ের ঢেউ,
কল্পনার নিঃসঙ্গতা আর চোখের প্রতি
তাকিয়ে থাকা একটানা নীরবতা হব।
বৃষ্টি থেমে গেল সেদিন
ভেজা কন্যার ভেজা চুলে চুমু খেয়ে ।
আর, তার শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে দিল
মেঘবৃষ্টির বাতাবরণ।
অনেকখানি সঙ্গোপনে
গুগলিরা বেরিয়ে ছিল নিশ্চলতা ভেঙে
দুর্দান্ত দুর্বিনয় প্রদর্শনে।
এমনতরো পথে বৃষ্টি শেষে
বৃষ্টিভেজা কোনো জলকন্যা দেখে
আমি তার পিছু পিছু হেঁটে
কথা বলেছি তার সাথে।
সমস্ত হৃদয় উজাড় করে
মিথ্যা প্রলোভনে যে দিয়েছিল আশা,
আর সমস্ত দিনের প্রত্যাশায়
কোনো সাতপাঁচ না ভেবে
কতশত জল্পনা-কল্পনার
সাতনরী হার।
পাংশুল বিকেল যখন
প্রকৃতির দেয়ালে ছায়ার অনুসারী
তখন শুনেছি আমি প্রত্যাখ্যানের সুর।
চূর্ণবিচূর্ণ হৃদয় দিয়ে আকাশের প্রতি তাকিয়ে
দেখেছি ইতস্তত মেঘের আনাগোনা।
টুবটুব করে ডুবে যাচ্ছিল
প্রচণ্ড চাওয়া-পাওয়ার ভার।
খরস্রোতা কর্ণফুলি পাশে বহমান।
সে তো জেনেছে তার পাশে বসে
তার স্রোতের সাথে আমার চোখের কতটি স্রোত মিশেছে।
তবু
গচ্ছিত রেখেছি এ হৃদয় সেই মেয়েটির জন্য।
পাহাড়ের সানুদেশে কতবার
সূর্য তারুণ্য পেয়েছে
আর কতবার জীর্ণ বৃদ্ধের
খসখসে চামড়ার মতো ম্লানিমায় ঢেকেছে–
তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
কেবলই ছবি হয়ে ভাসে
পাহাড়ে পথে হাঁটতে থাকা
বৃষ্টিস্নাত কুমারীর শাড়ির কুটিল আঁচল,
তার ইন্দ্রধনুর মতো বাঁকানো সাতরঙা শরীর।
মনের সে অপ্রাপ্তির গ্লানি
কোনোদিন মুছে যাবে না।
শ্রাবণের বারি ভাদ্রের প্লাবনে রূপ নিল।
হেমন্ত-শীত পেরিয়ে বসন্ত এল বৎসরের আবর্তনে।
আবার, আরও একটি শ্রাবণ এল।
রাবারের পাতা বেয়ে ফুল এল গাছে।
নদীর পাড়ে কেয়ার ঝোঁপে এল
গন্ধভরা উল্লাস।
মানবিক অভিসন্ধিগুলি
কুড়িয়ে নিলাম পদপিষ্ঠ পথ হতে।
আমার নিতান্ত কুটিরখানি
ছাওয়া হয়েছিল পাটখড়ি দিয়ে।
বাউনি বেয়ে বেয়ে ওঠা
ধুন্দুললতাতে ফুটেছিল
হলুদ বাসনা।
আবার, আমার হৃদয়ের রক্ত
নীল হয়েছিল
ফেলে আসা নতুবা স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া
কোনো মেয়ের প্রেমের কলঙ্কে।
বাউন্ডুলে মন সব অবহেলে ফেলে
এই পাহাড়ে ধারে বাধা পেয়েছে
বহিরাগত ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে।
পথের ধারে বাঁধা
জনাশ্রয়কে মনে হয়েছিল
আমার সারাটা জীবনের ঠিকানা।
তাই বুঝি এখানেই রয়ে গেলাম একটি বছর।
সেদিন আবহাওয়া ছিল বৃষ্টি হওয়ার উপযুক্ত।
বেরিয়ে পড়লাম বহিরঙ্গে।
মাথার মাঝখানে চুলে সিঁথি,
পরনে ফতুই,আর পাজামা,
আর পায়ে বাহারে নাগরা জুতো।
আমার পা দুখানি যেন চলে
বিহ্বল সেই ঝাউবাগানের প্রেক্ষাপটে।
বাতাসের সাথে ঝাউশাখাদের
টালমাটাল ফুর্তি।
একদিন যাকে বলতে পারি নি তোমাকেই ভালোবাসি।
একদিন যার হাত ধরতে পারি নি নিঃসঙ্কোচে॥
আর একদিন যাকে দেখার টান টান উত্তেজনায়
সারাদিন কেটে গেছে তার ছবি মনে এঁকে এঁকে॥।
আশ্চর্য! এখন মনে মনে কী ভাবছি, জান?―
প্রকৃতির টিলাপথে দেখা সেই বালিকার
সাথে যেন কিছুতেই মুলাকাত না হয়!
স্রষ্টার সর্বত্রই কারসাজি থাকে
মানুষের মনের বিপরীতে
কিংবা, মানুষের মানসের প্রতিবোধে।
ঝাউবাগানের তলদেশে বৃষ্টির আবহ,
আর দূরে বাগানের মধ্য দিয়ে টানাপথে
একবছর আগের পরিচিত কায়াধারিণী
সেই বালিকাটি―
যেন এগিয়ে আসছে ক্রমাগত
চোখে-মুখে আমাকে কিছু
বলবার অভীপ্সায়।
সীমন্তদেশ হতে নেমে যাওয়া তার একগুচ্ছ অলক,
মুহুর্মুহু পুরবি বাতাসে চোখের সামনে
মুখের সামনে এসে অন্ধকার করে দেয়।
আমার খুব প্রিয় আস়মানী রঙের
আজানুলম্বিত কামীস়,
তার সাথে নীল চুড়িদার,
নাকে গুলবনফ়্শার বানাফ়্সাজি নোলক
ও পরে এসেছে।
আমি আগে এমন ছিলাম না―
ওকে দেখে লজ্জায় আমার শির উঁচুতে
ধরে রাখতে পারলাম না।
কিন্তু, দেখলাম―ও অনেক পরিবর্তিত হয়েছে।
আমাকে কত সহজে বলছে―
“আমাকে মনে পড়ে?”
ওর বুকের উপর নীলরঙের দোপাট্টাখানি
তখন আঁচড়ে পড়েছে সমর্পণে।
মোহগ্রস্ত হৃদয় মিলনের মোহনায়
জানে নি―কী বলতে হবে।
আমার চোখে অলক্ষিত
বিকশিত এক আত্মা
তখন কথা বলে উঠল―
“জানতাম, আজ তুমি আসবেই।
আর জানতাম,আমার জন্যই।”
“আজ শ্রাবণের এগারো তারিখ,
তোমার জন্মদিন।
―আমি মনে রেখেছি।
তোমাকে দিব বলেই এনেছি।
এই নাও এগারোটি কাঠগোলাপ।”
আমি অঞ্জলি মেলে ধরলাম,
ওর ভালবাসার পুষ্প গ্রহণ করব―তাই।
আমি করতলে নিলাম এগারোটি কাঠগোলাপ।
আর, তখনই আকাশ বেয়ে নেমে এল বৃষ্টি।
আর, প্রথম বারিবিন্দু পড়ল
তোড়ায় বদ্ধ কাঠগোলাপের উপর।
সমস্ত সুরভি যেন ছড়ায়েছে ফুল।
সমস্ত ভালোলাগা যেন মিশেছে
আমাদের অন্তরে।
নিষ্পলক দুটো চোখ যেন আমাকে বেসেছে
যথেষ্ট ভালো।
নিষ্ঠুরতার কাজ করে বসলাম পরদিন।
বালিকাকে কিছু না বলে
কুটিরখানি ছেড়ে দিয়ে
চলে গেলাম অন্যত্র, অজানায়।
একদিন আমি ভালোবেসেছিলাম যাকে সে বলে নি কিছু―
আরেক দিন সে ভালবেসেছিল―আমি বলি নি কিছু―
কেবল স্মৃতির অব্যক্ত বুলি―
তার সাথে আমার শেষ দেখা হওয়া,
এই এগারোটি বৃষ্টিভেজা কাঠগোলাপের
মনমাতানো গন্ধ।
২৬ শ্রাবণ ১৪১৩
রমনা উদ্যান