মুহূর্তের অলিখিত কাব্য

  • ক্যাটাগরী: কবিতা

সকাল সাতটে বাজার আগেই

এসে অপেক্ষা করত ওরা তিনজনা।

আমি সেখানে পৌঁছুতে রীতিমত

দেরি করতুম।

পুরোটাই ইচ্ছেঘটিত বিলম্ব।

আর, একটা ভরসা ছিল―কখনওই ওরা

কৈফ়িয়ৎ চাইত না।

যখন যেতুম তখন নাটকসরণিতে

সক্কালবেলার স্নিগ্ধ রোদ মুছে যেত।

খানিক মিঠে-কড়া রোদ্দুরের স্বাদ পেতুম।

বুঝতুম―আজও ওরা আমার জন্যে

কালেজ ফাঁকি দিয়েছে।

সহানুভূতির শব্দগুলি বরাবরই চেপে যেতুম।

তিনটে মেয়ের পরনে থাকত

ধবধবে সাদা কামিজ়, স়ালওয়ার

আর কাঁধের দুপাশ দিয়ে ফেলে রাখা

কেচি ওড়না।

রাস্তার দুধারের লোকগুলি কেবল চেয়ে থাকত।

ওদের চোখ দেখে ঠিকই বুঝতুম―

পারলে ওরা তিনটি মেয়েশুদ্ধ আমাকে আসামি করে

অভিভাবকের আদালতে বাদী হয়ে বিচার চাইত।

ওদের অসহায়ত্ব টের পেয়ে আমি বেশ মজা পেতুম।

আর, ভেতরে ভেতরে হাসতুম।

শহুরে রাস্তা―একপাশে ওদের কালেজ

আরেক পাশে ছেলেদের দাঁড়াবার

বিশেষ বন্দোবস্ত হিসেবে গাছের ছায়াস্বল্পতা।

তাও আবার কালেজ ছুটির বেলায় বিদায় নিত।

প্রায় দেখতুম―আমার বয়সী বেশ কিছু ছেলে

সেখানে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি করত।

দুপুর হলে ছেলেগুলির হাঁফছাড়ার জো;

তবুও প্রতীক্ষার আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই।

উঠি-কি-পড়ি ভালোবাসা বলতে যা বুঝায়

তা ওদের দেখে তবেই বুঝলুম।

বিধাতার কৃপা হত কি না জানি নে,

তবে, আমার বড়োই ইচ্ছে হত―

ওরা যাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকত

তাদের কালেজ হতে বের করে এনে

চারটি হাতের মিলন দেখেই

দম নিই।

উপরে সুবিস্তীর্ণ আকাশ,

নীচে রাস্তার পাশে পায়ে হাঁটা পথের উপরে প্রেমের পাঠশালা,

আর সেখানে শুভঙ্কর শিক্ষায়

ব্যস্ত কয়েকজন কিশোর ছেলে।

নাটকসরণির পাশে একটি বইয়ের দোকানে

বন্ধু শৌভিক আর আমি প্রায়ই এসে মঞ্চায়নের

সাময়িকী নিয়ে ঘাটাঘাটি করতুম।

সেদিন কি জানি কি মনে করে

পথের পাশে দাঁড়িয়েছিলুম।

আকাশে একচিলতে মেঘ,

কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি,

আবার মিঠে-কড়া রোদ্দুর।

প্রকৃতির এত হেলাফেলার মাঝে

রহস্যের মতো সহসা সামনে

এসে দাঁড়াল তিনটি অপরিচিতা বালিকা।

যেন বৃষ্টি শেষে তিনটে সাদা অপরাজিতা ফুল দেখলুম।

তিনজন এসেছিল তিনখানা হৃদয়ের অনুভবে,

আর আমি একজনা বুঝতে শিখেছিনু

তারা ভালোবেসেছে আমায়।

পূর্ণাঙ্গ পৃথিবী পরিপূর্ণতা পেয়েছিল

প্রাণবন্ত বালিকার হাস্যোজ্জ্বল মুখে।

কোথা হতে যেন কাঠবেলির বৃষ্টিভেজা গন্ধ

ভিজে ভিজে এসেছিল বাতাসে।

কপোট হৃদয়ের খুনিয়ারা বেশ কে যেন

উন্মোচিত করল নিজের হাতে।

হৃদয়ের তোড়জোড়ে বালক খুঁজেছিল বালিকারে,

দুরভিসন্ধি ছিল না মনে,

কেবল দুরূহ প্রতিজ্ঞা ছিল বালিকাকে আপন করে পাবার।

বাঙ্‌মুখ করেছিলুম আমি।

একটি মেয়ের গাত্রবর্ণ ছিল গোরা,

চোখে থাকত চশমা,

আবার মুখের মায়া তার সৌন্দর্যকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে নি।

তাকেই কি বলেছিলুম সচেতন কি অচেতনে–

“কেন তুমি মিছে একা পথে চললে?”

আলোড়িত আঁখি মেলে বিচিত্র চাউনি

আমার প্রতি দৃক্‌পাত করল।

চোখের অক্ষর চোখ চেয়ে পড়ে নিলুম।

মাঝের মেয়েটি ছিল শ্যামলা।

চূর্ণকুন্তল বলতে যা বুঝায় তার চুল ছিল তেমন।

সেও কথা বলল―“দ্যাখ্ কী দুষ্টু ছেলে,রোশনি!”

বললুম―“দুষ্টুমি না করলে অপরিচিতার সাথে

কখনও কি পরিচয় হত? হয়তো পথের

মাঝে দেখা, চোখে চোখে মিলন হত।

অচেনা নক্ষত্রের মতো হৃদয়ের মাঝে

তোমার দীপ্তি জ্বলে উঠত ক্ষীণসময়ে।

একসময় সে দীপ্তিও নিভে যেত।”

চশমাপরা মেয়েটি বলল―“এমনটা তো

হররোজই হয়।”

“আমার কথা কিন্তু থামে নি―সে নক্ষত্রকে

আমি ধ্রুবতারা করে রাখতে চাই।”

দুষ্টুমি করে নক্ষত্রের নামটিও জেনে নিলুম।

লজ্জাবতী ছুঁয়ে দিলে যেমন হয় আমার কথাও

তেমনি মেয়েটিকে স্পর্শে নিস্তেজ করে দিল।

প্রেমের ব্যাপারে আমি যে পুরোযায়ী―তা এই প্রথম বুঝলুম।

যাক্! এই প্রথম কোনও মেয়ের হৃদয় তোলপাড় করে দিলুম।

অশরীরী আশাবরি রাগিণী।

কল্পলোকের কথা কল্পলোকেই ভালো মানায়।

যার জান সম্পূর্ণ প্রেমে মগ্ন,

প্রথম আলাপে যার হৃদয় হয়েছে ভগ্ন,

আর যার কথা চিন্তা করে আমার

চোখের পানি ঝরোঝরো হয়েও ঝরছে না

গভীর কোনও অনুভবের তীব্রতায়।

আজ অথবা কাল তার সাথে দেখা করতে

মনে মনে চাইতুম,

প্রতিবার আসতুম, আবার ফিরেও যেতুম মনোভঙ্গে।

তখন ছিল বর্ষাঋতু।

ভেবেছিলুম, শরৎ এলে একটা পদ্মফুল দিয়ে বলব―

“যাকে খুঁজেছিনু তাকেই পেয়েছি।

আর, সেই প্রাপ্তির অংশীদারিত্বে।”

স্বপ্নে দেখলুম―বনের পথে ওকে পাশে

নিয়ে হাঁটছি আর আমি আবৃত্তি করে চলছি

আমারই একগুচ্ছ কবিতা। আশেপাশে যেন সৃষ্টি করা

কোনো করুণ কাব্যময় পরিস্থিতি।

আর বলছি―“তোমার ঠোঁট দুটি যেন পদ্মের পাপড়িছোঁয়া।”

বালিকার চোখ-মুখ আর ভাষার অসাড়তা যেন দূর হল।

আর বললে―“তোমার কবিতা

আমার গীতিকা

এই দুয়ে মিলে হোক অবিরত লেনাদেনা।”

আমি আর সব চেনা শব্দ ভুলে বললুম―

“কথা যত আজ সব বলব মুহূর্তের অলিখিত কাব্যে।”

যার আঁচল ছুঁয়েছে বনের বাতাস,

যার হৃদয় অপ্রকাশিত বিশাল আকাশ,

যার কল্পনা মনে আসা সকালের সন্ধ্যার

বহমান সময়ের ঘোলাটে ব্যস্ততা,

যাকে বলেছি―“তুমি কথা বলো না,

ঠোঁটে লেখা তোমার বলবার কথাগুলি পড়ে নিই।”

পার্থিব হয়েছে প্রেম বস্তুতান্ত্রিক সমাজে।

আর, বনের গাছ হতে একগুচ্ছ বেলিফুল তুলে

ওর খোঁপার কাঁটায় গেঁথে দিলুম।

শৌভিক সেদিন আসল না।

আমি আসলুম, রইলুম পথের পথিক হয়ে।

সেই মেয়েদের দুজনকে দেখলুম।

রোশনির কথা জানতে চাইলুম ওকে না দেখে।

শ্যামলা মেয়েটি বললে―“আমার নাম কিন্তু

তোমার জানা হয় নি।”

আমি বললুম―“তোমার নাম তোমারই থাক

আমি তোমার নতুন নাম দিলুম শৈলী।

এ নামে তুমি হয়ে থাকবে আমার।

আর, তোমার পাশে তোমার বান্ধবীটি

―ও তো কথাই বলে না।

ওর নাম দিলুম অভিব্যক্তি।”

সাথের মেয়েটি অনন্যোপায় হয়ে বললে―

“এতক্ষণ তোমার কথা শুনছিলুম।

অনন্তকালের মাঝে একটি টানারেখা যেন তুমি এঁকেছ।

অনতিদীর্ঘ পথে চলো না।

তোমার সাথে কথা হবে আর তোমার

বক্তব্যের সাক্ষী রাখব ঝিলের পানি আর

বাগানের পাখিকে।”

স্বীকার করেছিনু ওর অনুভবকে স্বচ্ছন্দে।

জানতে চাইলুম―“তোমরা কি পথের পাশের এই কালেজে পড়?”

ইতিবাচক উত্তর পেয়ে বললুম―“কালেজ ফাঁকি দিয়েছ?”

ওরা হেসে ফেললে।

সেই হাসির কি যথার্থতা ছিল?

আরও আলাপ করে বুঝলুম―

নিরবচ্ছিন্ন মেয়ে তো এরা নয়।

অভিব্যক্তির করুণাভরা চোখে দেখেছি―

তার মনে দৈহিক প্রেমের লালিত্য আছে।

আরও পরে জানতে পারলুম―

কোন একটা ছেলেকে তার ভীষণ পছন্দ।

সামনের উদ্যানে ছেলেটা আসবে বলে কথা।

সেজন্যেই তারা এ পথে চলছে।

উদ্যানে তৈরি হয়েছিল একটি কৃত্রিম হ্রদ।

বর্ষায় আকাশের পানি ঝরে ঝরে

তা কানায় কানায় পরিপূর্ণ।

কোনও কমী নেই তার আশপাশের সৌন্দর্যে।

আমি বিমুগ্ধ হয়ে ভাবলুম―

আমি কমবখ়্‌ত্ এত দিনে শহরের মাঝে

সুন্দরের ঠিকানা পেলুম।

অভিব্যক্তি বললে―“আমরা একেই ঝিল বলি।

প্রতিদিন কালেজ ফাঁকি দিই

শুধু এর জল দেখতে।

আর জান, যখন এর সামনে দাঁড়াই

পা দুটো ভিজিয়ে নিই এর জলে

তখন আশপাশের বাতাস আমাদের

গায়ে আনন্দ-সোহাগের শিহরণ তোলে।”

বাতাস তখন কোন একটা ফুলের গন্ধে ভারাক্রান্ত।

শৈলীকে প্রশ্ন করলুম।

ও বললে―“নাগেশ্বর―একান্তই বর্ষার দোসর।

আমি যখন এই ঝিলের ধারে দাঁড়াই

তখন আমার নিজেকে বড়ো বলে মনে হয়।”

তীরময় এলৈস়া আর কলমির ঘন সাযুজ্য,

গগনে কালো মেঘ,

কোত্থেকে একটা সাদা বক

এসে বসল এতসবের মাঝে।

ঝিলের পারের ঐ কাঁঠালগাছটির ডালে

মধ্যাহ্নের শতমুখী চিত্র আরও বিচিত্র হয়।

এতসব দেখে আমাদের মনে জাগা রঙে

কে যেন সাজগোজ করেছে আজ;―

বেশ করে আমাকে দেখাবে বলে,

আমাকে ভুলাবে বলে।

আর, প্রকৃতির এই শ্যামল রূপ

তার সাজের সরঞ্জাম যোগান দিচ্ছে।

অসহায় দৃষ্টিতে তাকালে শৈলী।

অভিব্যক্তি আমাদের পাশে নেই।

ঝিলের পাড়ে একটা গন্ধরাজের ঝোপের পাশে

ও বসলে আমাকে বসবার অনুরোধ জানিয়ে পাশে।

গল্পে গল্পে কেটে গেল প্রহর।

অভিব্যক্তি ঘণ্টা দুয়েক পরে এলে।

সবাই মিলে গেলুম শহরের চেনা পথে।

কথা দিয়ে গেলুম পরদিন আসব।

পরদিন গেলুম, রোশনিও আসলে।

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলুম―

কি যেন বলবে। মুখের কথার ভার মুখই সইতে পারছে না।

আমি আর ও উদ্যানের বেঞ্চিতে বসলুম।

আর, রোশনির দুজন বান্ধবী ঘুরে দেখছে জায়গাটি।

ঝিলের পাড়ে ফুটে থাকা কয়েকটা জবা ছিড়ে দিয়ে

বললুম―“কুঁড়িতে ঘুমিয়ে থেকে এরা ফুটেছে,

আমাকে ভুলে থেকে যেমন তুমি আজ এসেছ।”

“তোমার কথায় বড়ো হেলাফেলা,

আমি ধরতে পারি নে”―রাগ হয়ে

বললে কি না, বুঝি নে।

মনের যে ভালোবাসা মনে মনে হয়

সে কেন মুখে প্রকাশ হতে চায়?

রোশনির পাশে বসে

কত কথা শুনেছিনু ওর মুখে।

একটি মেয়ের জীবনের কথা।

তার ঢেউখেলানো জীবনের করুণ সব অভিজ্ঞতা।

মধ্যদুপুরে যেমন বাউলমনে গানের ধুঁয়া—

উড়ো উড়ো বাতাস গাছের পাতার মৃদুলতায়

জানান দেয় আপনার কথা—

হৃৎপিণ্ডের কাঁপনে ধরা পড়া

প্রেয়সীর মুখে চেয়ে থাকি পর পর

সমস্ত লজ্জা ভুলে।

রোশনি হলুদ রঙের নাম-না-জানা একটা ফুল

দিয়ে বললে―“এই নাও।

গন্ধহীন বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ো না এটাকে।

এ যে মৃত্তিকার মূর্ছিত ছন্দ।”

আমি বললুম―“গন্ধহীন কেন বলছ?

বলো, এ যে গন্ধহারা ফুল।”

বিধ্বস্ত হৃদয় কতখানি বুঝেছিল সে কথা

কে জানে?

শ্রাবণের ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিপাত শুরু হলে

ওর চুলের দিকে তাকালুম।

বাদলে কলমির ডালে ফুটেছিল তার বেগুনী ফুল।

সেও দেখেছে এসবের মাঝে আমাদের দুজনারে

কানে কানে বলেছে।

থাক্, কানের শোনা কথা মুখে নাই বললুম।

পাতাকুড়ানি ছোট্ট একটা মেয়ে এসেছিল

হাতে একটা গোলাপ নিয়ে।

তার কাছ থেকে কিনে নিলুম সেটা।

অন্যের হাতে আমার ভালোবাসার বহির্প্রকাশ

কেন হবে?

কিছু দিন…

কিছু দিন গেলুম ভুলে।

চেনা পথ আর মাড়াতে যে ইচ্ছে করে না।

একদিন খামখেয়ালে দুপুর বারোটা হবে–

নাটকসরণি হতে উদ্যানে যেতে

একটা বড়ো রাস্তা পেরুতে হয়

তা-ই পার হচ্ছিলুম।

দেখলুম―পাতাকুড়ানি সেই মেয়েটি

হাতে একটা খাম আর একটা গোলাপ

আমাকে দিয়ে বলল―“অ্যাদ্দিন আহেন নাই ক্যান্?

চশমাপরা হেই আফ়ু কাইল দিয়া গ্যাচ়ে এই ফ়ুল;

আর ওই আফ়ু অহন দিচ়ে এই খাম।”

(ওর হাতের ইশারা অভিব্যক্তির প্রতি)

হাত পেতে নিয়েছি দুইজনের ভালোবাসা।

একমুষ্টিতে গত কালের বাসি-বিবর্ণ গোলাপ,

আরেক মুষ্টিতে অভিব্যক্তির চিঠির খাম।

আমি জানি নে কার ভালোবাসা নিতে হয়?

―যে প্রেমের দুয়ারে টোকা দিয়ে ফিরে গেছে,

না যে ব্যক্ত ভালোবাসার স্বার্থপর পূজারী,

তার।

পাতাকুড়ানি মেয়েটিকে বললুম―“খামটি

যে দিয়েছে সেই যেন চিঠিখানি গুঁজে রাখে।

আমি নিয়ে গেলুম গত কালের বাসি-বিবর্ণ-ফ্যাকাশে-মলিন

ফুল।”

মনে হল, আমার প্রেম

যেন আমি ফিরে পেয়ে গেছি।

১৭ আশ্বিন ১৪১৩

গোলবাগ