গোরু লিখব? না গরু? কেন?
রবি ঠাকুরের সহজ পাঠ পড়ে আমার মতো বাঙলা ভাষায় যাদের হাতেখড়ি হয় নি ওকার যোগে গোরু বানান দেখলে তাদের পিলে চমকে উঠবে—এ বড়ো অস্বাভাবিক কি? কারণ, বানান যে শুধু করার বস্তু নয়, দেখারও বস্তু। অবশ্য, রবি ঠাকুরকেও পরে গোরু শব্দটি ওকার বিয়োগে গরু বানানে লিখতে দেখা গেছে। অতএব, গোরু শব্দটি ওকার যোগে, না ওকার বিয়োগে লেখা উচিত এ বিতর্ক অনেক পুরনো।
এক দিকে শ্রদ্ধেয় ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ওকার যোগে গোরু লিখতেন, অপর দিকে রবি ঠাকুর পূর্বে ওকার যোগে গোরু লিখতেন ও পরে ওকার বিয়োগে গরু লিখতেন। ঠাকুরপরবর্তী লেখকদের রচনায় আমরা ওকার বিয়োগে গঠিত গরু বানানটি দেখতে পাই। কিন্তু কোন শব্দটি সঠিক এবং তা কেন সঠিক?
গোরু শব্দের ব্যুৎপত্তি ও ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:
বানানের যথার্থতা নিরূপণের পূর্বে আমি গোরু শব্দটির ব্যুৎপত্তি বিশ্লেষণে যাব। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, গোরু শব্দটি তদ্ভব শব্দ হলেও যে তৎসম শব্দ থেকে শব্দটির আবির্ভাব তার অর্থ আঙরেজী cow বলতে যা বোঝায় তা নয়। ভেঙে বলি, গোরু শব্দটি তৎসম গোরূপ [गोरूप/ɡoːˈɽuː.pɐ] থেকে আগত যার অর্থ হল, গোরুর মতো দেখতে কিছু। আঙরেজীতে bovine, cow-like, cow-shaped। মহাদেব শিবের অপর নাম গোরূপ। তৎসম গোরূপ শব্দটি অথর্ববেদ (কাণ্ড ৯ : ৭ : ২৫) ও মহাভারত (পুস্তক ১৩ : ৭৩৭)-এ দেখা যায়। আঙরেজী cow অর্থে তৎসম শব্দ গো [गो/ɡoː] প্রচলিত।
সুতরাং, গোরু শব্দটির অর্থ ও তার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ভিন্ন বিধায় গোরু শব্দটি একটি রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ।
গোরূপ>গোরূ>গোরু
গো শব্দটির অন্য ভাষার সমার্থক শব্দ:
প্রাচীন কয়েকটি ভাষায় গো শব্দটির সমার্থক শব্দ
সংস্কৃত | আভ়েস্তা | প্রাচীন গ্রীক | প্রাচীন আর্মেনীয় | মিসরীয় |
गो | ???????????? | βοῦς | կով | ???? |
go | gao | boûs/voûs | kov | kuʀ |
গো | গাও্ | বো~স়্/ভ়ু~স়্ | কোভ়্ | কুড়্ |
আধুনিক কয়েকটি ভাষায় গো শব্দটির সমার্থক শব্দ
অসমীয়া | নেপালী | উড়িয়া | হিন্দী | মারাঠী | ফ়ারস়ী |
গৰু | गोरु* | ଗୋରୁ | गाय | गुरूँ | گاو |
goru | goru | goru | gāy | gurū̃ | gɔ̄v |
গোরু | গোরু | গোরু | গায়্ | গুরূঁ | গ~ভ়্ |
*নেপালী ভাষায় শব্দটির অর্থ বলদ গোরু।
ছকে দেখা যাচ্ছে, কেবল প্রাচীন গ্রীক ব্যতীত উল্লিখিত প্রতিটি ভাষায় গোরুর সমার্থক শব্দ ক বা গ দিয়ে শুরু এবং অসমীয়া, নেপালী ও উড়িয়া ভাষায় বাংলা ভাষার গোরু শব্দটিই ব্যবহৃত হচ্ছে।
মধ্যযুগীয় বাঙলায় গোরু শব্দটি:
মধ্যযুগের কবিদের লেখায় গোরু শব্দটি কয়েকটি বানানে দৃষ্ট হয়। গোরূ, গোরু, গোরো এমনকি গরু বানানেও শব্দটি বড়ু চণ্ডীদাস, মালাধর বসু প্রভৃতিজনের লেখায় দেখা যায়। তবে গুরুঅ বলে একটি শব্দকে অনেকে গোরুর বানানভেদ বললেও গুরুঅর অর্থ কিন্তু ভারী এবং তা মধ্যযুগের কাব্যে ভারী অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। আমি শব্দটিকে তৎসম গুরুক [गुरुक/ɡuˈɽu.kɐ] শব্দজাত বলে মনে করছি। মধ্যযুগের কাব্য থেকে উদাহরণ:
হরিআঁ গোপীর হার আঅর বসনে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন : যমুনাখণ্ড
হাসে হাসি খলখলি কাহ্নাঞিঁ গরুঅ মনে॥
বাঙলা উচ্চারণ বিধি:
সংবৃত অ ধ্বনি অর্থাৎ [ɔ]-এর পর ই/ঈ/উ/ঊ বা এদের কারচিহ্নযুক্ত ব্যঞ্জন থাকলে অ ধ্বনি ও ধ্বনি হয়ে উচ্চারিত হয়। এটি বাঙলা ভাষার একটি প্রধানতম উচ্চারণ রীতি।
গোরু উচ্চারণমূলক বানান নয়, ব্যুৎপত্তিমূলক বানান
গোরু/গরু কোনটি লিখব?
আমি বলব গোরু ও গরু উভয় বানানই শুদ্ধ। কারণ, একটি শব্দের একটিই বানান থাকবে এমন কোনও রীতি নির্ধারিত হওয়া উচিত হবে না। কারণ, ভাষা পরিবর্তনশীল এবং পরিবর্তনশীলতা গুণ থাকা সত্ত্বেও ভাষা তার রক্তপ্রবাহে পূর্বের ঐতিহ্য বহন করে চলে। বানানও তথৈবচ।
- অসমীয়া ব্যতীত বাকি যে কয়টি ভারতীয় ভাষায় গোরু বানানটি ছকে প্রদত্ত হয়েছে সে কয়টিতে তা ওকার যোগে প্রযুক্ত হয়েছে। তৎসম গোরূপ থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে গোরু বানানটি বানান করার যুক্তি থেকে সঠিক। ওকার যোগে গোরু বানানটি শব্দের ইতিহাস সন্ধানের প্রচেষ্টামাত্র।
- বাঙলা ভাষার প্রধানতম অভিধানগুলো যেমন বাংলা একাডেমি প্রণীত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, শৈলেন্দ্র বিশ্বাস প্রণীত সংসদ বাংলা অভিধান গরু বানানের শব্দটিকে অপ্রচলিত বলে জ্ঞান করেছে। কিন্তু গত দুই-তিন দশকে বানানটি বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে ও সে সময়ের লেখকদের লেখায় এতবার ব্যবহৃত হয়েছে যে, শব্দটি এখন ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে। বাঙলা উচ্চারণের রীতি অনুসারে সরু, তরুর মতো দেখতে একই গরু বানানটিও বানান দেখার যুক্তি থেকে সঠিক। ওকার বিয়োগে গরু বানানটি শব্দের ঐতিহ্য রক্ষার প্রচেষ্টামাত্র।
২৫ আষাঢ় ১৪২৭
ঢাকা
দোহাই