আরেক অহনা

  • ক্যাটাগরী: কবিতা

              ১.

     রাস্তায় হাঁটছে কবিতা

     আমি তাকে আমাদের

     ঘরে তুলে আনি নি

     কারণ

     তার সাথে এখনও কোনো সম্পর্ক হয় নি

     কবিতা―সাথে তার মা

মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় পড়বার মতো বয়স

     প্রতিদিন দুপুরে খাবার সেরে

     অনেকটা বিকেলের রোদে

     বেরিয়ে পড়ছেন

     কবিতা যখন এখনকার

     কবিতার মতো হয় নি দেখতে

     তখন কবিতা আসত

     আমাদের ঘরে

     এমনি রোদ ম্রিয়মাণ হয়ে এলে

     বনিবনা না হলে

     আমি তার চুল টেনে ধরতাম

     কত নিষ্ঠুর ছিলাম আমি

     পড়ন্ত রৌদ্রের শেষকালে

     ছাদে উঠে যেতাম

     মা বলতেন, তোরা দুজনে

     হুসনাহেনার কাছে যাস নি

     আমি কী করে মানি

                    কথাটা

     সেখানে এলেই আমি ওকে জড়িয়ে পেতাম

     ভয়ঙ্কর রাতে স্বপ্নের মধ্যে

     রক্তচোষা বাদুড়

     এর পর ছেড়ে দিয়ে আমি তাকে

     সাদা কাগজে তুলে আনলাম

                          নকল করতে

               ২.

     কবিতা সংখ্যায় ছিল

                      তখন কম

     এরই মধ্যে একটা কবিতার

                      ওষ্ঠের স্পর্শে

     আমি মুখ ফুটে বলে ফেলি:―

     জান

     তোমার নাম ঠিক করে ফেলেছি,

                      অহনা

     এর পর একদিন স্কার্ট-শার্ট পরে

     বলে গেল, এভাবে আমি যুবতী

     হাঁ, তিনতলার জানালা দিয়ে প্রায় তো দেখি

     যেন কবিতার চোখ হতে মুখ, মুখ হতে বুক

                   বুক হতে চুল, শরীরের চুল

                   কামনার দুল আর আর রক্ত

     বলল, আমাদের বাড়ি আসবে

                    আমাকে দেখতে…

     সাহস হল না একেবারেই হাঁ হাঁ বলে

                     রাজি হয়ে যেতে

     শীতের পাখিরা যেমন রাতের কুয়াশা ডিঙিয়ে

     কুহেলী-আচ্ছন্ন এক ঝলক রোদের জন্য

     নিষিক্ত ডিমে তা দিয়ে বসে থাকে

     কথাটি আবার শুনতে ব্যাকুলতর আমি

               ৩.

মাটিতে পা ফেলার ঢঙে

নারকেল গাছের কাঠবিড়ালী

তুমি যত উঁচুতে উঠবে

     রাগে-অভিমানে

তোমাকে আঁকড়ে ধরার প্রতিযোগিতায়

                          আমি পারদর্শিতার

                          পরিচয়দানে প্রস্তুত

আমার বিচ্ছিন্ন এলোমেলো কথা

     ও কষে এক দৌড়

     বালির মাঠে দৌড়ুতে দৌড়ুতে বালুর বিছানা

     সেখানে এখনও পড়ে আছে ওর মাথার চুল

     ওর দেহধারী স্মৃতিচিহ্ন

দুজনার কোনোকিছু হয়ে যাওয়া

রাজস্থানের মরুবালিকা

তার স্বভাবসিদ্ধ আচরণে

আমাকে নিঃশেষ করতে চাইল

একদমের মধ্যে

তার চুড়ান্ত আক্রমণের সামনে পড়ে

প্রেমে ভরা একটা আত্মা

প্রেমহারা একটা দেহের কাছে

     হেরে গিয়ে বলল,

     তুমি ভালোবাসলে আর কাউকে ভালোবাসব না

     বেঁকে বসল মরুবালিকা

     আমাকে ওসব কেন বলছ

     আমি অন্যের অন্তঃসত্ত্বা

     পৌষের শেষের প্রথম হিমে

     হাঁড়কাঁপানো ঠান্ডায়

খটখট করে মুখ চেপে যাচ্ছিল দাঁতে

বলি, কেন-বা এসব

      বয়সের দোষে

এত দিনের পরিচয়ে প্রেমিকা যখন

প্রত্যাখ্যান করে বসে প্রেম

আমি ওসব ভাবি নি

আগুনের উপর হাত রেখে

আগুন পোহাই

একটা মেয়ের কাছে

            মাথা নত করে

            মরণ না হলে

আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরি

মরতে না যেয়ে অন্তরে মরে রইলাম

               ৪.

     ঘাসের মাঠ এসে মিশে আছে

     শীতকালের মাঠে

     অর্ধমৃত ঘাস

     লুটোপুটি করছে মর্মরে আক্রান্ত পাতারা

     বেলা একটা বাজা ঘড়ি

     অথচ বাইরে বর্‌ফ়্পড়া শীত

     সেই শীতের মধ্যে হঠাৎ দেখি

     একটি দিনের পোষমানানো সে পাখি

     মা-ছাড়া বেরিয়ে পড়েছে ছানা

     আমার কলজেয় ব্যান্ডেজ

     কালজয়ী প্রেমের প্রত্যাখ্যানে

     মনের মধ্যে আক্রোশে লেগে আছে প্রতিহিংসা

     কোনো এক মেয়ের মুখ

     ভাসতে ভাসতে যেখানে

     কল্পনার সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে

     অথচ আমি হারিয়ে ফেলি সেই সিঁড়ি

     পরিচিত পৃথিবীর আরেক আকার

     চেনাজানা পৃথিবীর নতুন কোনও বৃত্তান্তে

     মোড় নিয়ে ঘুরে আসে অন্য এক মুখ

     কারণ ঘূর্ণিবাতের মোড়কে আটকে যায়

     জগতের কোনো অঞ্চল

বেঁচে থাকার একমুহূর্তে

কারও প্রতি প্রকাশ পেতে পারে সমস্ত করুণা

অবশ্যই সে করুণাময়ী তোমার বয়সী সে মেয়ে

সে হাত বাড়িয়ে দিতে পারে তোমার দিকে

তোমার মনে হয়তো তখন তার জন্য গড়া

     অন্য ভুবন

     সে অন্যের অনন্যতা প্রকাশ

     করতে তুমি হয়ে যাবে অসাড়

     তোমার আবেগ গ্রাস করবে

     তোমার শরীরকে

তখন তোমার আবেগের ঘনত্বের বৃত্তে

উঁকি দিতে থাকবে

সে মেয়ের মায়াছড়ানো হাসি

বর্তুল চক্রান্তে মানুষের দিনগুলি যেভাবে

আটকে যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মাত্রায়

কোনো মানবের সাধ্যি নেই

অস্বীকার করতে এমন পরিস্থিতি

সে মেয়ের খলখল হাসি কেড়ে নিতে পারে

তোমার অনুভবকে, কারণ সে যে দস্যু

সীমিত সময়ের পরিচয়ে

তার কাছে চেয়ে বসবে সীমাহীন

পরিচয়ের দাবি

মানবিক অভিজ্ঞতাকে তার কাছে

গ্রহণযোগ্য করে তোলার যোগ্যতা

তখন পাবে না তুমিও

               ৫.

হৃদয়ে হৃদয়ে দহনজ্বালা বয়ে বেড়াই

হেঁটে চলে গিয়ে ফিরে আসে হৃদয়ের কাছে

ভালোবাসা; যেন দাহ্য অপ্রাপ্তির মন্ত্রণায়

কুড়ে কুড়ে খাক আমার অসম্ভব অবাস্তবতাকে

এখন রোদ নেমে গেছে আকাশের মেঘ চিরে

কবিতা হাঁটাহাঁটি করে পৌঁছে যাচ্ছে তার

প্রকাশকের কাছে

এখানকার জায়গায় নাম বালুঘাট

অস্তিত্বের অপর এক অনুভব ছিল সে মেয়েটি

যে আর কখনও আমার সামনের পড়ে নি

তবু স্মৃতির ভাসা ভাসা অতীত ছুঁয়ে পাওয়া

অন্য এক অহঙ্কার―যাকে পরাজিত করে

করায়ত্ত্ব করার শপথ নিয়েছিরাম

সে শুধুই আমাকে আমার যাবতীয পরিচয়ের

মাঝে একা করে নিজেই চক্রান্তের জালে আটকায়

ভুলে যাব আমি তাকেই কিন্তু কী করে

          জীবনের কোনো খণ্ডকালে যে জেনে গেছে

          আমার তার প্রতি অসম্ভব দুর্বলতা

          কিংবা আজও সাদাখাতায় তার কথা

          লিখে তার সমস্ত স্মৃতি মস্ত একটা

          প্লটে ধরে রাখতে চেষ্টা করি

          আশঙ্কা এবং উৎকণ্ঠার রাজ্যজোড়া অভিসন্ধিতে

          আজও একই মেয়ের প্রতি আমি

          করুণাকাতর

এখনও মনের সাথে তীব্র লড়াই করে

সান্ত্বনা দিতে পারি না:

তাকে আমি ঘুণাক্ষরেও ভালোবাসি নি

ভীষণ বিষণ্নতায় পৃথিবী প্রভুর কাছ থেকে

ভিক্ষা করে আনা একেকটি দিন কেটে যাচ্ছে ।

আর সহ্য করতে পারছি না:

সেই মেয়েটির কাছে গিয়ে প্রেমভিক্ষা করি

               ৬.

যার চোখের দৃষ্টি আমাকে বুঝে নি

তার জন্য আমি চলে গেছি গরঠিকানায়

আমার শরীর হতে আত্মা বেরিয়ে গেছে

আর বুকফাটা বীভৎস আত্মচিৎকারে

আত্ম‌সাৎ করেছে পূর্বেকার যাবতীয় কিছু

ঈশ্বর কখনও মেলাবে না আমার জীবন

আমার ধারণার সাথে সঙ্গতি রেখে

আমার ডান হাতের পাতায় টানা রেখার সাথে

বাম হাতের পাতায় টানা রেখার কোনও মিল নেই

রেখার স্রোতে স্রোতে লেখা থাকতে পারে

আমার ভাগ্য―যা দেহধারী আত্মা

বয়ে বেড়াতে ইদানীং নাখোশ

আমার আত্মায় বাস করছে প্রথম জীবনের প্রেম

আর দেহের দৃষ্টিচোরা চোখ দুটো

আবিষ্কার করেছে শতাব্দীর পথে কাহিনী হতে পাওয়া

                                  অন্য কোনো মেয়ে

তার নামও সে বলে গেছে

অথচ নিজের থেকে সে নাম ভুলে গেছি

আত্মা আর দেহের মেলবন্ধনে তার নাম দিয়েছি;

                                     আরেক অহনা

অসমাপ্ত এক করূণ কণ্ঠস্বর বলে উঠছে

একরত্তি মৃত্যু নিয়ে আসে না কেন

পৃথিবীর কোনো ধর্মের যমদূত

পায়রারা ডানা উড়িয়ে নিয়ে গেছে হাতচিঠি

রাজকুমারীর বেশে থাকা প্রেমিকাকে দেবে বলে

সেখানে খৎ লেখা আছে:

কামানের সামনে যেন সে মেয়ে এসে দাঁড়ায়

গম্বুজের উপর বসানো বাঁকা চাঁদ-তারা চেয়ে রবে ঊর্ধ্বে

কিংবা মরুভূমির মরুবালিকা

যার জিভে ফেনিয়ে আসছে পিপাসার দাগ

সে মৃত্যুর কাছে চলে যাবে

অন্য জগতে প্রেম হয়ে ঘুরে বেড়াতে

এর পর লেগে যাবে যুদ্ধ আর কলহ ছেলেতে-মেয়েতে

পৃথিবীর সব হাতগুলি শক্ত হয়ে মুঠোয় ধরে রাখবে বিজয়

               ৭.

একদিন রাতের সাথে অন্ধকার নিযে আসবে কাম

আরেক অহনার অঙ্গ ছুঁয়ে আসছে পালকের

মতো হালকা যৌবন

আত্মা তখন আত্মীয়তা করবে

অপরিচিত কারো সাথে

যেন তার সাথে তার চেনাজানা গভীর দূরত্বের

বিছানায় উপুড় হয়ে থাকা দূরত্বের মতো দূরত্বে

তারা টানবে পরস্পরের নিশ্বাস

গলন্ত মোমের মতো আগুনে গলে লেপটে যাবে

তাদের দুজনার বুক

নিজেকে আমি অচেনা করে দেব আমার বর্ণনায়

শবনম ঝরে ঝরে রাতের শেষে

মলিন ঘাসে ভেজা হয়ে রবে

বিগত রাত্রির সাথে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকা

যার মন হয়ে গিয়েছিল একদিন একজনার

সে তো মুল্য বুঝে নি

তবু সেই মন তার সাথে বেঁধে দিয়ে

শহরে শহরে, পর্বতে পর্বতে

লাভার মতো অনন্ত অভিমানে

জেগে উঠেছে অহনার মুখ নিয়ে

একই অবয়বের অন্য কেউ

হয়তো আমারই কাছে দুজনার কোনও ফ়ারাক ধরা পড়ে নি

হয়তো মনে হয়েছে মাঝে মাঝে

ভুল বুঝে সে যেন রূপ পাল্টে এসেছে

নচেৎ আমার কাছে তাকে এত মোহনীয়  দেখতে কেন হয়েছিল

ছাইচাপা একটা নিভন্ত আগুনে

হাওয়া লাগিয়ে কে উস্কে দিতে চায়

তার সাথে আমার সম্পর্ক কী?

মনকে বারবার করে মানানো

সে যেন ফিরে এসেছে একই মুখ লয়ে, একই দেহ লয়ে

একই অক্ষত মানসিকতা আর

একই শরীরের উত্তাপ লয়ে

হারানো বস্তু খুঁজে ফিরে পাওয়া

এমনও লেখা ছিল আমার ভাগ্যের আঁখরে

               ৮.

আজকাল ভাগ্য তুরুপের তাস হয়ে ফিরে আসে

অথচ এমনি হবে অতীতের প্রাক্কালে

আমি খুঁজেছি যার আত্মার মতো উদার

কোনো আত্মা

আমি হয়তো প্রায় পেয়ে গেছি

তবু বুঝে উঠতে কষ্ট হয়

ফিরে ফিরে পাওয়া একেকজন

তবুও তাদের নাম কেন এক হয়

জাহান্নমের আগুন হতে আরেক জাহান্নমের আগুনে লাফ দেই

পিয়ালায় পিয়ালায় জহর ঢেলে

যেখানে অপেক্ষা করে আছে অশান্তি

শনৈঃশনৈ মরাবাঁচা যাদের

লিপিবদ্ধ হয়ে আছে আদিগন্ত

আমার মতো যাদের জীবনে আর কিছু হয় না

বারবার শুধু শুধু প্রেমে পড়া ছাড়া

তবুও আমরা প্রত্যেককে দেখি

প্রথমার আদলের সাথে মিলিয়ে

আমরাই বুঝি না আমরা কে?

ঈশ্বরের সৃষ্টি না অভিশাপ

এক অহনার মুখের প্রতি তাকিয়ে

আরেক অহনাকে গুলিয়ে ফেলি

প্রথমার সর্বাঙ্গের সাথে এক করে

হয়তো এমন জীবনের সমসাময়িকতায় যার মন

একবার প্রেমে ফাঁদে জড়িয়ে যায়

সে বরাবরই ভালোবাসে

এখন যাই হোক

মনের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে হলেও

এ হৃদয়ে শূন্যতায় আমি

                       কখনও থাকতে পারব না

১৬ পৌষ ১৪১৩

রমনা